• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ১৯ মে ২০২০  

রহমত, মাগফেরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস শুরু হতে না হতেই চোখের পলকে শেষ হতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। এ মাসের মূল উদ্দেশ্য হল সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাক্ওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করে তদনুযায়ী নিজের জীবনকে পরিচালনা করা।

দৈহিক রোজার সাথে সাথে আমাদের আত্মিক রোজা কতটুকু পালন করে এই মাসে আমরা তাক্ওয়া কতটুকু অর্জন করতে পারলাম তাও ভাবার বিষয়। কারণ, মকবুল রোজার জন্য পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি যাবতীয় পাপকর্ম থেকে বিরত থাকাও অন্যতম শর্ত।

এই মাস শুধুমাত্র রোযা রাখার মধ্য সিমাবদ্ধ নয়; বরং এই মাসের প্রতিটি মূহুর্ত ইবাদাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই মাসের প্রত্যেকটি দিন ও রাত অন্য মাসসমূহের দিনরাতের চাইতে অনেক উত্তম। আবার এই মাসের শেষ দশকে এমন একটি রাত্রি রয়েছে যে রাত্রির ইবাদাত হাজার মাসের ইবাদাতের চেয়েও উত্তম।

পবিত্র কুরআনুল কারিমে এই রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’ মহিমান্বিত বা ভাগ্য রজনী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই মাসে সিয়াম সাধনাসহ যতপ্রকারের ইবাদাত করার চেষ্টা আমরা করেছি, তার ভুল- ত্রুটি থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে মহান আল্লাহর দরবারে কবুল করানোর আরযি পেশ করার এটিই একমাত্র রজনী।

কদর’ শব্দটি আরবি। ইহার অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান। এই রাতের অধিক মাহাত্ম্য ও সম্মানের কারণে এটাকে মহিমান্বিত রজনী বলা হয়। আবার ভাগ্য অর্থেও শব্দটি প্রয়োগ হয়ে থাকে। তখন অর্থ হবে, এই রাতে মানুষের পরবর্তী এক বছরের ভাগ্য ফেরেশতাগণের কাছে হস্তান্তর করা হয়, যার মধ্যে মানুষের বয়স, মৃত্যু ও রিজিকসহ সব কিছু রয়েছে।

পবিত্র কুরআনুল কারিমের সাতানব্বইতম ‘আল-কদর’ পূর্ণাঙ্গ সুরাটিতে এই মহিমান্বিত রজনীর মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন-
‘নিশ্চয়ই আমি এটা (আল-কুরআন) মহিমান্বিত রজনীতে অবতীর্ণ করেছি। আর মহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে তুমি কী জান? মহিমান্বিত রজনী হাজার মাসের চাইতে উত্তম। ঐ রাত্রিতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরাঈল) তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে প্রত্যেক কাজের জন্য অবতীর্ণ হন। শান্তিময়, এই রাত ফজর উদয় পর্যন্ত।‘ (সুরা কদর)

সুরা দুখানের আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘পবিত্র রজনীতে তাকদীর সংক্রান্ত সব ফয়সালা লিপিবদ্ধ করা হয়।‘ (সুরা আদ-দুখান : ৪)
এর মর্ম হল, এ বছর যেসব বিষয় প্রয়োগ করা হবে, সেগুলো লাওহে মাহফুজ থেকে নকল করে ফেরেশতাগণের কাছে সোপর্দ করা হবে।

এই রজনীর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসেও বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। এই মাসের শেষ দশকে যেকোন দিন ‘লাইলাতুল কদর’ হতে পারে, তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ দশককে এত বেশি গুরুত্ব দিতেন যে, তিনি ইবাদাতের জন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি গ্রহন করতেন এবং পুরো রাত্রি জাগ্রত থেকে নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, দুয়া ও জিকিরের মাধ্যমে অতিবাহিত করতেন। এমনকি তিনি তার পরিবারের সদস্যদেরকেও ইবাদাত করার জন্য ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতেন। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “যখন রমজানের শেষ দশক আসত তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার চাদর কষে নিতেন (অর্থাৎ বেশি বেশি ইবাদাতের জন্য প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাতে জেগে থাকতেন ও পরিবার পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন”। (বুখারি, মুসলিম)
ইমাম ইবনে খুযায়মা ও বায়হাকী (রহ.) বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেন। শাবান মাসের শেষ দিনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসের মর্যাদা বর্ণনা করে দীর্ঘ এক ভাষণ প্রদান করেন এবং উক্ত ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন যে-
‘এই মাসে এমন এক মহিমান্বিত রাত রয়েছে যে রাতের মাহাত্ম্য হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। অন্য হাদিসেএসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “রমজান মাসে এমন এক রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল।‘ (নাসাঈ ও মুসনাদে আহমাদ)

এই রাতে অগণিত ফেরেশতা আল্লাহর বান্দাদের ইবাদাত পর্যবেক্ষণ করার জন্য যমিনে বিচরণ করে থাকেন এবং ফজর উদিত হওয়ার পর আসমানে আরোহন করে মহান আল্লাহকে বান্দাদের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন। হাদিসেএসেছে, “কদরের রাতে পৃথিবীতে ফেরেশতারা এত বেশি অবতরণ করেন যে, তাদের সংখ্যা পাথরকুচির চেয়েও বেশি”। [মুসনাদে তায়ালাসী: ২৫৪৫]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই রাতের নির্দিষ্ট কোন তারিখ উল্লেখ করেননি। শুধুমাত্র রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে তালাশের নির্দেশনা দিয়েছেন। হাদিসেএসেছে-
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কাদ্র তালাশ কর”। [বুখারি: ২০২০; সহীহ মুসলিম: ১১৬৯।] অন্য হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে: “তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কাদ্রের সন্ধান কর।‘ (বুখারি)

এই রাত্রিতে বিভিন্ন প্রকারের ইবাদাত রয়েছে। ততমধ্যে বিখ্যাত আলেমগণ এই রজনীতে ইবাদাতের পূর্বে গোসল করে নতুন পোশাক পরিধান করে সুগন্ধি লাগানোকে মুস্তাহাব বলেছেন। বর্ণিত আছে-

- আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু রমজানের চব্বিশ তারিখ রাতে গোসল করে নতুন কাপড় পরিধান করে শরীরে সুগন্ধি লাগাতেন।
- প্রখ্যাত তাবেয়ী ইব্রাহিম নখয়ী রাদিয়াল্লাহু আনহু লাইলাতুল কাদ্র উপলক্ষ্যে রমজানের শেষ দশরাতের সম্ভাব্য রাতগুলোতে গোসল করে সুগন্ধী ব্যবহার করতেন।
- কূফার প্রসিদ্ধ তাবেয়ী আবূ মারইয়াম ইবনে হুবাইশকে ছাব্বিশ তারিখ দিনগত সাতাশ তারিখ রাতে গোসল করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
- তাছাড়া প্রসিদ্ধ তাবেয়ী আইয়ূব সাখতিয়ানী রাদিয়াল্লাহু আনহু-সহ অনেক তাবেয়ীগণ রমজানের শেষ দশরাতের যেকোন একরাত লাইলাতুল কাদ্র হবে মনে করে শেষ দশরাতের অধিকাংশ রাতে গোসল করে নতুন পোশাক পরিধান করতেন এবং সুগন্ধি ব্যবহার করতেন।
সুতারাং ইহা থেকে বুঝা গেল, জুমআ এবং ঈদের মত এই রাতে গোসল করে নতুন পোশাক পরিধান করে সুগন্ধি মেখে আল্লাহর ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করা উত্তম।

এই রাতের আমলের মধ্য উল্লেখযোগ্য হল, ফরজের পর যত বেশি সম্ভব নফল নামায পড়া। কেননা, এই রাতের নফল নামাজের উসিলায় করুণাময় ক্ষমাশীল আল্লাহ বান্দার পূর্ববর্তী অপরাধগুলো মাফ করে দেন। হাদিসেবর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় নামাজের মাধ্যমে কাদ্র রজনী কাঠাবেন, তার পূর্ববর্তী গুণাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।‘ (বুখারি)

মহিমান্বিত রজনীর অন্যতম আমল হল কুরআ’ন তেলাওয়াত করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশরাতে এমনভাবে তারতীল সহকারে কুরআ’ন তেলাওয়াত করতেন যে, রহমত বা দয়া সংক্রান্ত কোন আয়াত অসলে তিনি আল্লাহর নিকট চাওয়া ছাড়া পরবর্তী আয়াতে যেতেন না। আর আযাব বা শাস্তি সংক্রান্ত আয়াত আসলে তিনি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা ছাড়া পরবর্তী আয়াত তেলাওয়াত করতেন না এবং প্রত্যেক আয়াত তেলাওয়াতের সময় গভীরভাবে চিন্তা করতেন।

হজরত আবূ দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের মধ্য কেউ একরাতে কুরআ’নুল কারীমের এক তৃত্বীয়াংশ পড়তে কী অক্ষম? প্রতি উত্তরে বলা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দ.)! কে ঐটাতে সক্ষম হবে? এই উত্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা ইখলাছ পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।‘ (মুসনাদ তায়ালাসী)

দোয়া এই রাতের গুরুত্বপূর্ণ আমলসমূহের মধ্য অন্যতম। সুফ্ইয়ান সূরী রাদিয়াল্লাহু আনহু এই রাতে নফল নামাজের চাইতে দু’য়াকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ, এই রাতে মহান আল্লাহ বান্দার ফরিয়াদ বেশি বেশি কবুল করেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা লাইলাতুল কদরের আমল সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে জানতে চাইলে তিনি আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। (সুনানুল কুবরা)
জিকির এই মহিমান্বিত রজনীর অন্যতম একটি আমল। কারণ, জিকির হল বান্দা কর্তৃক আল্লাহর মহত্বের ঘোষণার অন্যতম মাধ্যম। মহান আল্লাহর বিশেষ ফেরেশতাগণ যমিনের মধ্য জিকিরের মজলিস তালাশে মগ্ন থাকেন এবং কোথাও জিকিরের মজলিস পেলে সেখানে শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেষ্টনী দিয়ে রাখেন; মজলিস শেষান্তে আসমানে আরোহন করে মহান আল্লাহর নিকট জিকিরকারী বান্দাদের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন।

তাই ভাগ্য রজনীতে জিকিরের মাধ্যমে বান্দা এই সুযোগটি গ্রহন করতে পারেন। সহীহ মুসলিমের হাদিসেবর্ণিত হয়েছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন-
‘আল্লাহর ভ্রাম্যমাণ বিশেষ (রিজার্ভ) কিছু ফেরেশতা রয়েছে। তারা শুধু বান্দার জিকিরের মজলিসসমূহ অনুসন্ধান করে বেড়ায়। তাঁরা যখন জিকিরের কোন মজলিস পায় তখন সেখানে জিকিরকারী বান্দাদের সাথে বসে যায়। তারা একে অপরকে পাখা দিয়ে বিস্তার করে এমনভাবে বেষ্টন করে রাখে যাতে তাদের ও আসমানের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানও পূর্ণ হয়ে যায়। জিকিরের মজলিস যখন শেষ হয়, তখন তারা আসমানে আরোহণ করে। আল্লাহ তাদেরকে কোথায় থেকে ফিরেছে জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা যমীনে অবস্থানকারী আপনার এমন একদল বান্দাদের নিকট থেকে এসেছি যারা আপনার জিকির করে এবং আপনার কাছে তাদের কাঙ্খিত বস্তুর প্রার্থনা করে । তখন আল্লাহ বলেন: আমার বান্দারা আমার কাছে কি চায়? ফেরেশতারা উত্তর দিয়ে বলেন, তারা আপনার কাছে আপনার বেহেশত প্রার্থনা করে। আল্লাহ বলেন, তারা কি বেহেশত দেখেছে? ফেরেশতারা বলেন, না; তারা দেখেননি। আল্লাহ বলেন, তারা যদি আমার বেহেশত দেখত তাহলে কী করত? তারা বলেন, তাহলে তারা আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করত। তিনি বলেন, কিসের থেকে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করত? তারা বলেন, হে আমাদের প্রভূ! জাহান্নাম থেকে। তিনি বলেন, আমার বান্দারা কী জাহান্নাম দেখেছে? তারা বলেন, না; তারা দেখেননি। তিনি বলেন, যদি তারা জাহান্নাম দেখত তাহলে কী করত? তারা বলেন, তাহলে তারা আপনার কাছে মাগফেরাত কামনা করত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তখন আল্লাহ বলবেন, আমি আমার ঐ জিকিরকারী বান্দাদের ক্ষমা করে দিলাম এবং তারা যা আমার কাছে চেয়েছিল আমি তা তাদের দান করলাম।‘ (মুসলিম)
সুতারাং এই মহিমান্বিত রজনী প্রত্যেক বান্দার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই রাতেই মহান আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের পরবর্তী একবছরের ভাগ্য ফেরেশতাদের নিকট হস্তান্তর করেন। তাই এই রাত্রিতে জাগ্রত থেকে বিভিন্ন প্রকারের ইবাদাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা প্রত্যেক বান্দার উপর কর্তব্য।