• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ
ব্রেকিং:

রাসূল (সা.) এর জীবন্ত দু’টি মুজিজা

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ৪ নভেম্বর ২০১৯  

আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তার আগে সৃষ্টি করেছেন শয়তান ও জিন জাতিকে। শয়তান ছিল অনেক বড় ইবাদতগুজার। আল্লাহ তায়ালার নৈকট্যপ্রাপ্ত মাখলুক।

কিন্তু তার ভেতর ছিল অহংকার। এ কারণে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তায়ালা যখন নির্দেশ জারি করলেন, ‘সকলে আদমকে সেজদা কর’। তখন শয়তান তাঁর নির্দেশ অমান্য করে। আর এই নির্দেশ অমান্য করার অপরাধে সে জান্নাত থেকে বিতাড়িত হয়। তখন শয়তান দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করে, ‘আমি আদম সন্তানকে সরল পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য সব দিক থেকে হামলা করব।’ শয়তানের অপতৎপরতার হাত থেকে রক্ষা করে, মানব জাতিকে সরল পথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে নবী এবং রাসূল প্রেরণ করেছেন। নবী-রাসূলকে বিশেষ কিছু ক্ষমতা দেয়া হতো। ওগুলো দিয়ে তারা যুগের অন্যান্য মানুষের ওপর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতেন। ওই বিশেষ ক্ষমতাই হচ্ছে মুজিজা।

নবীগণের মুজিজা, যুগের চাহিদা ও প্রচলনের দিকে খেয়াল করে দেয়া হতো। যে যুগে, যে বিষয়টি বেশি প্রচলিত ছিল, ওই বিষয়ের সর্বোচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিষয়টি আল্লাহ তায়ালা নবীগণকে দিতেন। যেমন হজরত ইসা (আ.) এর যুগে চিকিৎসা শাস্ত্রের বেশি প্রচলন ছিল। আল্লাহ তায়ালা ইসা (আ.)-কে চিকিৎসা শাস্ত্র সংক্রান্ত মুজিজা দিয়েছেন। তার মুজিজা ছিল মৃত মানুষকে জীবিত করা। শ্বেত রোগীকে সুস্থ করা। এ দু’টি এমন মুজিজা, যা কারো পক্ষে করে দেখানো সম্ভব ছিল না। 

মূসা (আ.) এর সময় জাদু বিদ্যার খুব প্রচলন ছিল। জাদুকররা মূসা (আ.)-কে জাদু দ্বারা পরাজিত করতে চাইল। আল্লাহ তায়ালা তার লাঠিকে জাদুর মোকাবিলায় ব্যবহারের নির্দেশ করলেন। দেখা গেলো তার লাঠি এমন কার্যকর এক বস্তুতে পরিণত হলো, যার সামনে সকল জাদুকররা মাথা নত করতে বাধ্য হলো।

রাসূল (সা.)-কে আল্লাহ তায়ালা পূববর্তী নবীগণের তুলনায় অনেক বেশি মুজিজা দান করেছিলেন। চন্দ্রকে দু’টুকরা করার মুজিজা। এটি একটি জীবন্ত মুজিজা। যারা চাঁদের দেশে প্রথম গিয়েছিলেন, তারা চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করার মুজিজা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এদের একজন রাসূল (সা.) এর সে মুজিজা দেখে মুসলমান হয়ে যান। ভারতের অনেক লোক সেই মুজিজা দেখেছিলেন এবং রাসূল (সা.) এর দরবারে হাজির হয়ে মুসলমান হয়েছিলেন, এমন ঘটনাও ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। রাসূল (সা.) এর অনেক মুজিজা থাকলেও এর মধ্যে দু’টি মুজিজা হচ্ছে জীবন্ত ও এখনো আমাদের সামনে বিদ্যমান। (এক) আল কোরআন। (দুই) আরব জাতির উত্থান।

আল কোরআন জীবন্ত মুজিজা:
অনেক আধুনিক মনের মানুষ মুজিজা বা নবীগণের অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা শুনে বিশ্বাস করেন না। অনেকে মনে মনে হাসেন। যেহেতু মুজিজা দেখানোর পর তা বিলিন হয়ে যায় তাই এখন কেউ চাইলেই মুজিজা এনে তাকে সরাসরি দেখানো সম্ভব নয়। তবে আল কোরআন হচ্ছে ওই মুজিজা, যা এখনো আমাদের সামনে বিদ্যমান। আল কোরআন নাজিল হওয়ার পরই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন, ‘আর তোমরা যদি সেই বাণী সম্বন্ধে সন্দেহের মধ্যে থাক যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি-তবে তার মতো একটি সূরা (রচনা করে) নিয়ে আস এবং (সহযোগিতার জন্য) আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে ডেকে নাও।’

আল কোরআনের এই চ্যালেঞ্জকে অনেকে গ্রহণ করে সূরা বানিয়েছিল। কিন্তু কোরআনী বাণীর যে গভীর মর্ম, ওদের বানানোটা এর কাছেও হয়নি। কথিত আছে যে, সূরা ‘কারিয়া’ এর সঙ্গে মিল রেখে একজন একটি সূরা বানিয়ে ছিল। শব্দের কিছুটা মিল থাকলেও অর্থ ছিল একেবারেই অসার। আরবী সাহিত্যের যারা খোঁজ খবর রাখেন, আলী তানতবীর নাম জানেন না এমন কেউ নেই। তিনি শুধু কোরআন, হাদিসই পড়েননি। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানেও তার পাণ্ডিত্ব ছিল অতুলনীয়। অধ্যয়ন করেছেন অক্সফোডসহ দুনিয়ার নামিদামী অনেক প্রতিষ্ঠানে। তিনি লিখেন ‘অক্সফোডে আমার এক আরব সাথী ছিল। সে বলতো কোরআনের মতো সাহিত্য কেউ রচনা করতে পারবে না, আমার বিশ্বাস হয় না। একদিন আমি তার এই বক্তব্যের উত্তরে বলি, আচ্ছ আপনি নিজের ভাষায় বলুন তো ‘জাহান্নাম অনেক বড়।’ আরবী ভাষায় বড় বা প্রসস্ত বুঝানোর জন্য ‘واسعة – فسيحة- ’ শব্দদ্বয় ব্যবহার হয়। সে আলোকেই আমার ওই বন্ধুটি বলল, ان جهنم واسعة فسيحة – অর্থাৎ জাহান্নাম বিশাল বড়। তখন আমি বলি, দেখুন, আপনার কথা এবং আল্লাহ তায়ালার কালামের মাঝে কত পার্থক্য! আল্লাহ তায়ালাও এই বিষয়টিই বুঝিয়েছেন। কিন্তু তার বলার ভঙ্গি এত উন্নত যে, তা মানুষের সক্ষমতার বাইরে। আল্লাহ তায়ালার ভাষায়  يَوْمَ نَقُولُ لِجَهَنَّمَ هَلِ امْتَلَأْتِ وَتَقُولُ هَلْ مِنْ مَزِيد অর্থাৎ কেয়ামতের দিন আমি দোজখকে জিজ্ঞেস করবো, ‘তুমি কি পূর্ণ হয়েছ?’ আর দোজখ তখন বলবে ‘আরো কি আছে?’ (সূরা ক্বাফ-৩০) এর দ্বারাও উদ্দেশ দোজখের বিশালতা বুঝানো। কিন্তু এখানে সরাসরি জাহান্নাম বড় এ-কথা না বলে অন্য ভঙ্গিতে বলা হয়েছে। তখন ওই বন্ধুটি হতভম্ব হয়ে গেল যে, ঠিকই তো আল্লাহ তায়ালা কত উন্নত ভঙ্গিতে কথাটি বুঝিয়েছেন।

কোরআন মুজিজা হওয়ার একটি বড় দলীল হচ্ছে, তা অবিকৃত থাকা। কোরআন নাজিল হয়েছে আজ থেকে ১৪ শ বছরেরও বেশি সময় আগে। এত লম্বা সময়ে কোরআনের কোনো বাক্য তো দূরের কথা, একটি হরফও এদিক সেদিক হয়নি। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা নিজে এর হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন তাই কেয়ামত পর্যন্ত এতে কোনো বিকৃতি হবে না। কোরআন মুজিজা হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে এর হেফজ সহজ হওয়া। আমরা যদি চাই দ্বিতীয় শ্রেণির একটি বই হেফজ করবো। তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ করে কাউকে শুনাব। আমাদের পক্ষে তা সম্ভব হবে না। কিন্তু এত লম্বা কোরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ শুনাচ্ছেন, এমন লোকের সংখ্যা গণনা করে শেষ করা যাবে না। মাত্র সাত-আট বছরের ছোট ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত মুখস্থ শুনিয়ে দিচ্ছে। এটা আল্লাহ তায়ালার বিশেষ কিতাব না হলে কখনো সম্ভব হতো না।

পাশ্চাত্যের গবেষকরাও বিষয়টিকে মেনে নিয়েছে। কোরআনের শক্তি সম্পর্কে ইমানুয়েল ডাস্ বলেন, ‘একটি পুস্তক যার সাহায্যে আরবরা মহান আলেকজান্ডার অপেক্ষা রোম অপেক্ষা, পৃথিবীর বৃহত্তর ভূভাগ জয় করতে সক্ষম হয়েছিল, রোমের যত শতক লেগেছিল তার জয় সম্পূর্ণ করতে, আরবদের লেগেছিল তত দশক। এরই সাহায্যে সমস্ত সেমেটিক জাতির মধ্যে কেবল আরবরাই এসেছিল ইউরোপে রাজারূপে, যেখানে ফিনিসীয়রা এসেছিল বণিকরূপে, আর ইহুদীরা এসেছিল পলাতক বা বন্দীরূপে।’ (ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, জগতের আদর্শ মহামানব) 

কোরআনের শাব্দিক অলঙ্কার ছাড়াও মর্মের গভীরতা, তথ্যের সমৃদ্ধতা, মানুষের মনোজগতে প্রভাবের দিকটি অতুলনীয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত কোরাআন পড়ে বা বাচ্চা বয়সে যারা কোরআনের সংস্পর্শে আসে তাদের চরিত্র হয় নরম ও মানবীয়। পক্ষান্তরে, যারা কোরাআনের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে তাদের চরিত্র হয় কর্কষ ও স্বার্থপরতা। কোরআনের মুজিজা হওয়ার বড় একটি প্রমাণ হচ্ছে, যারাই কোরআনকে মিটিয়ে দেয়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কোরাআন রিসার্চ করে, এক সময় তারাই কোরআনের ভক্ত বনে যায়।

আরব জাতির উত্থান:
আরব জাতির উত্থানও নবী করিম (সা.) এর একটি মুজিজা। শুধু আরব নয় বরং তার দ্বারা বিশ্বের বুকে সাধিত হয়েছিল এক বিপ্লব। অতি অল্প সময়ের মাঝে অজ্ঞ, ভাসমান একটি জাতিকে বিশ্ব নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করা সাধারণ কোনো বিষয় নয়। অনেক মহান ব্যক্তি পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করেছেন। সফলও হয়েছেন অনেকে। কিন্তু তাদের সফলতা ছিল মানজীবনের অংশবিশেষে। তাদের সফলতা ছিল সাময়িক। আরবদের উত্থান ছিল মুহাম্মাদ (সা.) এর মুজিজা এ সম্পর্কে টমাস কারলাইন বলেন, ‘আরব জাতির পক্ষে এ ছিল আধার থেকে আলোর জন্ম; তারা এতে পেল মহৎ জীবন। এক গরিব রাখালের জাতি পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে তারা মরুভূমিতে  অজ্ঞাতভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, এক বীর নবীকে ওপর থেকে পাঠানো হলো তাদের কাছে এমন কথার সঙ্গে, যা তারা বিশ্বাস করতে পারে। দেখতে অজ্ঞাত হচ্ছে জগদবিখ্যাত, ক্ষুদ্র হচ্ছে জগদবৃহৎ। তারপর এক শতাব্দীর মাঝে গ্রানাডা থেকে দিল্লি পর্যন্ত বীর্য-ঐশ্বর্যে আর প্রতিভার আলোকে আলোকিত হয়ে আরব জাতি পৃথিবীর এক বড় অংশের ওপর আলো দিচ্ছে। একটি মৃত জাতির জীবনদান, এ কি শত-সহস্র মৃত ব্যক্তির জীবনদানের চেয়ে অলৌকিক নয়?’ আরব জাতির উত্থানের বর্ণনা দিতে গিয়ে ইমানুয়েল ডাস্ বলেছেন, ফিনিসীয়রা ইউরোপে এসেছিল বণিকরূপে, ইহুদীরা এসেছিল পলাতক বন্দীরূপে। কেবল আরবরাই এসেছিল বিজয়ীরূপে। তাহলে নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর ছোঁয়া পেয়ে আরব জাতি কতটা সমৃদ্ধ হয়েছিল আন্দাজ করা যায়!

ইসলামের আদর্শ এখনো বিশ্ববাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অনেক আদর্শ আছে, যা বিশ্ববাসীর জন্য এখন অপ্রাসঙ্গীক, কিন্তু তা প্রচার হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে। পাশ্চাত্য জগত ইসলাম নিয়ে গবেষণা করছে। এর দ্বারা নিজেরা উপকৃত হচ্ছে। কোরআনের তথ্যকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন বিষয় আবিস্কার করে যাচ্ছে। কিন্তু মুসলমানরা ইসলাম ও কোরআন থেকে বিমুখ হয়ে আছে। অথচ পাশ্চাত্যের এক গবেষকের লেখায় ইসলাম ও মুসলমানদের অবদান ফুটে উঠেছে এভাবে, ‘কেবল তারাই এসেছিল-যখন চারদিকে ছিল অন্ধকার, গ্রীসের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে মৃত্যু থেকে বাঁচিয়ে তুলতে; দর্শন শাস্ত্র, চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ও সঙ্গীতের সোনার শিল্প পূর্ব-পশ্চিমকে শেখাতে, আধুনিক বিজ্ঞানের শৈশব দোলার কাছে দাঁড়াতে।’ ইসলামের জীবনী শক্তি এখনো আছে, কেউ যদি হিম্মত করে কাজে লেগে যায়, বিশ্ববাসীকে আবারো জাগিয়ে তুলতে পারবে।