• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

২৫ দেশে যাচ্ছে মাস্ক পিপিই

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ৭ আগস্ট ২০২১  

দেড় বছর ধরে একটা ইংরেজি বাক্য যত্রতত্র ঝুলছে। বারংবার নজরে আসায় বাক্যটি আমজনতার এখন প্রায় মুখস্থ। বাক্যটির নাম 'নো মাস্ক নো সার্ভিস'। সরকারি-বেসরকারি সব অফিসেই মানুষকে মাস্ক না পরলে কোনো সেবা দেওয়া হবে না মর্মে সতর্ক করা হচ্ছে।

করোনা সংক্রমণ রোধে দেশে মাস্কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন এটাই নিয়ম। নিয়মের কারণে এবং মানুষের নিজস্ব তাগিদেই মাস্ক, পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই), হেডওয়্যার, কাভারওয়াল এবং অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রীর চাহিদা বেশ বেড়েছে। বাহ্যিক আবরণ হিসেবে মোটামুটি ৯ ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদন করেন দেশের উদ্যোক্তারা। দেশে-বিদেশে এসব পণ্যের রয়েছে উচ্চ কদর। এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রসহ ২৫ দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের পিপিই, মাস্কসহ অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী।

গেল ২০২০-২১ অর্থবছরে বস্ত্র ও পোশাক রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে সুরক্ষাসামগ্রীর রপ্তানি বেড়েছে ২৩ শতাংশেরও বেশি। মোট ৬২ কোটি ডলার বা পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি টাকার এসব পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরে রপ্তানি বেশি হয়েছে এক হাজার কোটি টাকার ওপরে। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিযোগ্য ৯ রকমের সুরক্ষাসামগ্রীর মধ্যে ডলারে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি এসেছে ওভেন কাপড়ের তৈরি 'ফুল বডি ওভেন স্যুট' রপ্তানি থেকে। সারা শরীর ঢেকে রাখা এই ধরনের পিপিই বেশি রপ্তানি হয় বাংলাদেশ থেকে। সুরক্ষাসামগ্রীর মোট রপ্তানির মূল্যের অর্ধেকেরও বেশি ৩৩ কোটি ডলার রপ্তানি হয়েছে এই পণ্যের মাধ্যমে। এই ক্যাটাগরির পোশাকের মধ্যে নারী-পুরুষ এবং ছেলেমেয়েদের আলাদা ধরন আছে। আলোচ্য সময়ে নারীদের উপযোগী পিপিই সবচেয়ে বেশি ১৮ কোটি ডলার রপ্তানি হয়েছে। সাধারণ ব্যবহারকারীদের সঙ্গে করোনাকালে বেশি ঝুঁকিতে থাকা সন্তানসম্ভবা মায়েরা বাড়তি নিরাপত্তায় এ পণ্যটি বেশি ব্যবহার করেছেন।

সুরক্ষাসামগ্রীর রপ্তানি প্রবণতা বিশ্নেষণে দেখা যায়, বাজার বুঝে উঠতে উদ্যোক্তাদের একটু সময় লেগেছে। এ কারণে দুই বছর আগে করোনা সুরক্ষাসামগ্রীর বাজার তৈরি হলেও করোনাকালের প্রথম বছর রপ্তানি বাজারে খুব একটা ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারেনি বাংলাদেশ। ভবিষ্যতের বাজার নির্ভর করবে সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর। করোনা সংক্রমণ কমে গেলেও মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা থাকবে বলে অনেকে মনে করছেন।

মাস্ক রপ্তানিতে বেশি প্রবৃদ্ধি :করোনা সুরক্ষাসামগ্রীর মধ্যে শতাংশের হিসাবে কাপড়ের তৈরি মাস্কের চাহিদা বেশি ছিল গত অর্থবছরে। আগের অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি বেশি হয়েছে ৩৬৯ শতাংশ। মোট ১১ কোটি ডলার অর্থাৎ প্রায় এক হাজার কোটি টাকার মাস্ক রপ্তানি হয়েছে। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত কমবেশি এক ডলারের মতো দর পাওয়া যায় প্রতি পিস মাস্ক রপ্তানি থেকে। আগের অর্থবছরে মাস্কের রপ্তানি ছিল মাত্র ২ কোটি ২৫ লাখ ডলার।

বিজিএমইএ সূত্র জানিয়েছে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের মাস্কের বড় বাজার ছিল জার্মানি। দুই কোটি ৩৭ লাখ পিস মাস্ক রপ্তানি হয়েছে দেশটিতে। অন্যদিকে, পিপিই সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। প্রায় ১১ লাখ পিস পিপিই রপ্তানি হয়েছে দেশটিতে।

মাস্ক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাস্কের বাজার এখনও চীনের দখলেই। কারণ, শ্রমঘননির্ভর না হওয়ায় চীন সহজে এই পণ্যটি উৎপাদন ও রপ্তানি করছে। শ্রমঘননির্ভর পণ্যে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের বাড়তি সুবিধা থাকে। মাস্ক উৎপাদনে বেশি মজুরি ব্যয় হয় না। সে কারণে মাস্কের বাজারে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে চীন।

ডেনমার্কের দুটি কোম্পানির কাছে গত বছর ১৫ লাখ পিস মাস্ক রপ্তানি করেছে এমএস ডাইং ফিনিশিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। জানতে চাইলে কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুনুর রশীদ জানান, মাস্কের বাজার খুব বেশি বাড়ার সম্ভাবনা কম। তার ব্যাখ্যা, ইউরোপের প্রায় শতভাগ টিকাদান সফল হয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সুরক্ষায় মনোযোগ কমে গেছে। সে কারণে চাহিদা কমে আসছে। মামুনুর রশীদ বলেন, গোটা বছরের হিসাব বিবেচনায় নিলে শতাংশে মাস্কের রপ্তানি বেশি হয়েছে ঠিক। তবে অর্থ বছরের শেষ দিকে মাস্কের রপ্তানি ধীরে ধীরে কমছে। নতুন করে কোনো রপ্তানি আদেশ পাননি তারা।

মেডিকেল প্রটেকটিভ গিয়ারের চাহিদা বাড়ছে :সুরক্ষাসামগ্রীর মধ্যে চার ধরনের মেডিকেল প্রটেকটিভ গিয়ার উৎপাদন করেন দেশের উদ্যোক্তারা। এর মধ্যে কৃত্রিম আঁশ বা ম্যানমেইড ফাইবারের মেডিকেল প্রটেকটিভ গিয়ারই বেশি রপ্তানি হয়। সমাপ্ত অর্থবছরে ছয় কোটি ডলারেরও বেশি রপ্তানি হয়েছে পণ্যটি। আগের অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি বেশি হয়েছে ৬৬ শতাংশ। চিকিৎসক এবং নার্সদের ব্যবহার উপযোগী কাপড়ের তৈরি পিপিই রপ্তানি বেশি হয়েছে ৩১০ শতাংশ। মূল্য মিলেছে চার কোটি বা প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। অ্যাডাম অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল হক মুকুল বলেন, সুরক্ষাসামগ্রীর বাজার বুঝে উঠতে সময় লেগেছে তাদের। কত ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী হয়, সেগুলো কীভাবে তৈরি করতে হয়- এসব বিষয়ে অন্ধকারে ছিলেন তারা। তিনি বলেন, হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ সব পর্যায়ের কর্মীদের পিপিই, মাস্ক, টুপি এগুলো উৎপাদন এবং রপ্তানি করছেন তিনি। ফ্রান্সভিত্তিক একটি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গোটা ইউরোপে যাচ্ছে এসব পণ্য। যত চাহিদা, তার সবটুকু তিনি সরবরাহ করতে পারছেন না। পরিমাণে বেশি পণ্যের চাহিদা থাকায় ভালুকায় নতুন করে একটি কারখানা স্থাপন করেছেন। করোনার কারণে ক্রেতারা আসতে পারছেন না। ক্রেতারা অবকাঠামো দেখার পর উৎপাদন শুরু করার পরিকল্পনা আছে তাদের।

রপ্তানি বাড়াতে যত চ্যালেঞ্জ :উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদন এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। রপ্তানি বাজার দেশগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শর্ত মেনেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এই অনুমোদন দিয়ে থাকে। এতে বড় একটা সময় ব্যয় হয়েছে উদ্যোক্তা রপ্তানিকারকদের। এ ছাড়া নতুন ধরনের এবং সংবেদনশীল হওয়ায় এসব পণ্যের মান নিশ্চিত করার কলাকৌশল, প্রযুক্তি ও লোকবল তৈরিতে কিছুটা সময় ব্যয় হয়েছে। এ কারণে করোনার প্রথম বছর সুরক্ষাসামগ্রীর বিশ্ববাজারে খুব ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। ধীরে ধীরে এসব কৌশল এখন উদ্যোক্তাদের আয়ত্তে এসেছে। এতেই বাজার রপ্তানি এবং পণ্যের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। পরিসংখ্যান সে কথাই বলছে।

এ ছাড়া সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদন এবং রপ্তানিতে এখনও অন্যতম বড় সমস্যা হচ্ছে, প্রধান কাঁচামাল কাপড়। বিশেষায়িত ধরনের কাপড় এখনও বাংলাদেশে বলতে গেলে উৎপাদন হয় না। এ ধরনের কাপড় সাধারণত ম্যানমেইড ফাইবারে তৈরি হয়ে থাকে। জীবাণুরোধী গুণাগুণও থাকতে হয়। প্রযুক্তির আরও কিছু বিষয় থাকে। ইন্দোনেশিয়া ও চীন থেকেই এসব কাপড় আনতে হয়। দেশি উৎস থেকে বিশেষায়িত এ ধরনের কাপড় সংগ্রহ করা গেলে লিড টাইমের সুযোগ কাজে লাগানো সহজ হতো। লিড টাইম হচ্ছে, ব্র্যান্ড এবং খুচরা ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রপ্তানি আদেশের আলোচনা শুরুর পর বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত সময়। বাংলাদেশ থেকে এ প্রক্রিয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছয় মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এসব সমস্যা সমাধান করা গেলে আগামীতে আরও বেশ ভালোভাবে সুরক্ষাসামগ্রীর বিশ্ববাজার দখলে নেওয়া সম্ভব হবে বলে আশাবাদী উদ্যোক্তারা।

বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিকেএমইএ, বিজিএমইএর সদস্য নয়- এ রকম অনেক প্রতিষ্ঠানও পিপিই ও মাস্ক রপ্তানি করে থাকে। তার আশা, রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার সুযোগ তৈরি করেছে করোনা সুরক্ষাসামগ্রী। গত প্রায় দুই বছরেই করোনা যেভাবে চরিত্র বদলেছে, পৃথিবীর এক অঞ্চল ভালো তো অন্য অঞ্চলে সংক্রমণ বাড়ছে। তাতে মনে হয়, করোনা সহজে যাচ্ছে না। সুরক্ষাসামগ্রীর চাহিদা থেকেই যাবে।

অভ্যন্তরীণ বাজারে রপ্তানিযোগ্য মাস্ক :দেশে দফায় দফায় করোনা সংক্রমণের ঢেউয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারেও মাস্কের ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়েছে। প্রথম দিকে পিপিইর প্রতিও একটা ঝোঁক ছিল সাধারণ মানুষের। কম সময়েই সেই ঝোঁক কেটে যায়। একপর্যায়ে মানুষ বুঝতে পারেন, পিপিই মূলত স্বাস্থ্যকর্মী ও সম্মুখসারির যোদ্ধাদের কাজে লাগে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে পিপিই ব্যবহার আর তেমন দেখা যায় না। তবে সবার মুখেই বা পকেটে মাস্ক থাকছে এখন। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। তবে ঠিক কী পরিমাণ মাস্ক দেশে ব্যবহার হয়, তার সঠিক তথ্য জানা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, কাঠামোগত সক্ষমতার অভাবে ক্যাবের কাছে আপাতত মাস্কের ব্যবহারের তথ্য নেই। তবে ব্যাপক হারে এ সুরক্ষা পণ্যটি যে ব্যবহার হচ্ছে, সেটা সাধারণ চোখেই দেখা যায়। রপ্তানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে ঊর্মি গ্রুপের তুরাগ প্রোটেক্স মাস্ক। গ্রুপ সূত্রে জানা গেছে, বছরে তারা ১০০ কোটি তুরাগ মাস্ক উৎপাদন করেন। অভ্যন্তরীণ বাজারে বিপণন হচ্ছে তুরাগের একটা বড় অংশ।