• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

হাসন রাজা প্রয়াণের শত বছর

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ৬ ডিসেম্বর ২০২২  

“লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার
কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার
ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার”

এই গান শোনেনি, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক কম। গানের রচয়িতা মরমী কবি এবং বাউল হাসন রাজা। দেশ, জাতি, ধর্ম এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের একটি ধর্ম রয়েছে, যাকে মানবতা বলে। এই মানবতা সাধনার একটি রুপ হলো মরমী সাধনা। যে সাধনা হাসন রাজার গান এবং দর্শনে পাওয়া যায়। তিনি সর্বমানবিক ধর্মীয় চেতনার এক লোকায়ত ঐক্যসূত্র রচনা করেছেন। তাঁর রচিত গানগুলো শুনলে মনের মাঝে আধ্যাত্মবোধের জন্ম হয়। এক সময়কার প্রতাপশালী অত্যাচারী জমিদার হাসন রাজা একটা সময় এসে একজন দরদী জমিদার এবং মরমিয়া কবি ও বাউল সাধক হয়ে ওঠেন।

আজ তার শততম প্রয়াণবার্ষিকী। এই ডিসেম্বর মাসেই জন্ম হয়েছিল তাঁর। আবার শূন্যের মাঝে ঘরও বানিয়েছিলেন এই ডিসেম্বরে। 

সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী পরগণার তেঘরিয়া  গ্রামে এই মরমিয়া কবির জন্ম। ৭ পৌষ ১২৬১ ও ২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে (ইংরেজী সাল অনুযায়ী) দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী এবং মোসাম্মৎ হুরমত জান বিবির ঘর আলোকিত করে জন্ম হয় হাসনের। হুরমত বিবি ছিলেন আলী রাজার খালাতো ভাই আমির বখ্‌শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা। পরবর্তীতে হাসন রাজার পিতা আলী রাজা তাকে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। হাসন রাজা ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র।

হাসনের পূর্বপুরুষের অধিবাস ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের অয্যোধ্যায়। বংশ পরম্পরায় তাঁরা হিন্দু ছিলেন। অতঃপর তাঁরা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলা হয়ে সিলেটে এসে থিতু হন। তাঁর দাদা বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী সিলেটে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। 

হাসন বেশ সুপুরুষ দর্শন ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান এবং পংক্তি রচনা করেছেন। এছাড়াও আরবী ও ফার্সি ভাষায় ছিল বিশেষ দক্ষতা। তখন সিলেটে ঘরে ঘরে আরবী ও ফার্সির প্রবল চর্চা চলত।

হাসন যৌবনে ছিলেন ভোগবিলাসী এবং সৌখিন। বিভিন্ন সময় তিনি অনেক নারীর সাথে মেলামেশা করেছেন। প্রতি বছর, বিশেষ করে বর্ষাকালে, নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ নৌকাবিহারে চলে যেতেন এবং বেশ কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে দিতেন। এই ভোগবিলাসের মাঝেও হাসন প্রচুর গান রচনা করেছেন। বাইজী দিয়ে নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হত। সেই গানের মাঝেও অন্তর্নিহিত রয়েছে নশ্বর জীবন, স্রষ্টা এবং নিজের কৃত কর্মের প্রতি অপরাধবোধের কথা। কে জানতো সেই অত্যাচারী, ভোগবিলাসী জমিদারই হবেন পরবর্তীকালের সবচেয়ে প্রজাদরদি এবং দরবেশ জমিদার!

সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়া এলাকায় সুরমা নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে হাসন রাজার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। এটি এখন সুনামগঞ্জের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। বাড়িটিকে জাদুঘর বানিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে সাধক হাসনের ব্যবহৃত কুর্তা, খড়ম, তরবারি, পাগড়ি, ঢাল, থালা, বই এবং নিজ হাতে লেখা কবিতা ও গানের পাণ্ডুলিপি। এসব দেখে হাসনকে খানিক বোঝার চেষ্টা করা যায়। খানিক খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা যায়, মরমি হাসন কতটা রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন।

হাসন রাজার ভক্তদের দাবি জাদুঘরটির সংস্কার করা। নইলে চলছে না। কারণ, গত বন্যায় এর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মূল্যবান জিনিসপত্র রক্ষা করতে হলে এর সংস্কারের বিকল্প নেই। 

হাসন রাজার ব্যবহৃত অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র আছে, যা অনেকেই জানেন না। সংরক্ষণের জায়গা ঠিকঠাক না থাকায় সেগুলো মানুষকে দেখানো যাচ্ছে না। হাসন রাজার নামে আলাদা একটি কমপ্লেক্স করা তাই সময়ের দাবি।

হাসন রাজা ট্রাস্টের সভাপতি ও হাসন রাজার প্রপৌত্র দেওয়ান এমদাদ রাজা চৌধুরী বলেন, “বন্যার কারণে হাসন রাজা মিউজিয়ামটির অবস্থা বেশ করুণ হয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে হাসন রাজাকে নিয়ে চর্চা করার সুযোগ পায়, সে জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন দরকার।”