• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

শালদুধ শিশুর জীবনের প্রথম টিকা

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ২ অক্টোবর ২০২১  

ডেলিভারি বা সিজারের পর বাচ্চাকে নিয়ে মায়েরা একটা স্বাভাবিক সমস্যায় থাকে যে বাচ্চা দুধ পাচ্ছে না। এটি খুব বেশি সমস্যা নয়। বাচ্চা জন্মের পর সাধারণত যে মেইন মিল্ক লেটডাউন হয়, সেটা হচ্ছে বাচ্চার জন্মের তিন দিন পর। তাহলে প্রথম দিন এবং দ্বিতীয় দিন যে শাল দুধ পাওয়া যায় মায়ের, সেটাই বাচ্চার জন্য উপকারী। বাচ্চার যেটুকু পুষ্টির দরকার, এই শাল দুধ থেকে সে পরিমাণ পুষ্টি পাওয়া যায়। সুতরাং বাচ্চার জন্মের প্রথম দুই দিন সেই শাল দুধটাই বাচ্চাকে দিতে হবে। শালদুধ শিশুর জীবনের প্রথম টিকা

শাল দুধটা পরিমাণে কম থাকে, তবে এটা ধবধবে সাদা থাকে না। সে জন্য মায়েরা একটু বিভ্রান্ত হন। এই দুধ বাচ্চার জন্য কতটা উপকারী হবে, বাচ্চার পেট ভরবে কি না, এসব ব্যাপারে।

মায়ের দুধ শিশুর জীবনধারণ ও বৃদ্ধির জন্য সুষম খাদ্য।  জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। শিশু জম্মের ৬ মাস বা ১৮০ দিন পর্যন্ত শিশুকে শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। এ সময় পানি বা অন্য কোনো পানীয় খাওয়ানোর দরকার নেই। কেননা, মায়ের দুধেই আছে শতকরা ৯৫ ভাগ পানি। অন্যান্য পুষ্টিগুণ তো আছেই। ৬ মাসের পার থেকে পরিপূরক খাবারের পাশাপাশি ২ বছর পর্যন্ত শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। শিশুকে দিনে রাতে ৮-১২ বার বুকের দুধ খাওয়ানো যেতে পারে।
 
শিশু মায়ের গর্ভে যে সুন্দর পরিবেশে ছিল, সেই সুন্দর পরিবেশ থেকে যখন দুনিয়াতে আসে, তখন দুনিয়ার এসব ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া সবকিছুর বিরুদ্ধে শিশুর শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে মায়ের বুকের এই শাল দুধ।
তারপর বাচ্চার ইলেকট্রোলাইট দরকার হয়, পানির দরকার হয়, এসব কিছুই শাল দুধ থেকে পাওয়া যায়। এ ছাড়া বাচ্চার যে পরিমাণ গ্লুকোজ দরকার প্রোটিন দরকার সেটাও শাল দুধে থাকে।

সুতরাং দুধ আসছে না বলে যে সকল মায়েরা অস্থির হয়ে যায়, যে সকল মায়েরা নতুন মা হন তারা তো আসলে বুঝেন না। এক্ষেত্রে পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যারা বয়স্ক আছেন কিংবা যারা এই সময়টা পার করে এসেছেন তারা নতুন মায়েদের কাউন্সেলিং করবেন। তারা নতুন মায়েদের বোঝাবেন যে, প্রথমে যে দুধ আসে সেটাই বাচ্চার জন্য দরকার, এখান থেকেই বাচ্চা সব ধরনের পুষ্টি পাবে।
 
কারণ বাচ্চা এখন মাত্র দুনিয়াতে এসেছে, সে যে এখনই খুব বেশি খাবে তা তো নয়। এই বাচ্চার জন্য যতটুকু খাবার দরকার ততটুকু খাবারই আল্লাহ মায়ের কাছে দিয়েছেন। আল্লাহ যদি এর থেকে বেশি দিত এবং সেটা যদি বাচ্চা না খেত, তখন দেখা যেত যে মায়ের বুকে ব্যথা হতো, মায়ের কষ্ট হতো। সুতরাং বাচ্চার জন্মের প্রথম দুই দিন যতটুকু দুধ প্রয়োজন, ততটুকু দুধই বাচ্চার জন্য আসে। এটাই বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে। এটা খাওয়ার পরে বাচ্চার যে পুষ্টির প্রয়োজন, তার সবটুকু পূরণ হয়।

তবে কিছু আছে এর থেকে আলাদা। এক্ষেত্রে যেসব মায়েদের আনকন্ট্রোলড ডায়াবেটিস থাকে, বাচ্চা অনেক বড় থাকে, সেক্ষেত্রে হয়তোবা আরেকটু বেশি পুষ্টির প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে বাচ্চার ওজনের উপর ভিত্তি করে, বাচ্চার বাড়তি খাবারের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সেটা শতকরা খুব কমই হয়ে থাকে। যদি দরকার হয় সেক্ষেত্রে ডাক্তাররা পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
সাধারণত ডেলিভারির পর প্রথম দুই দিন যে শাল দুধ মায়ের থেকে পাওয়া যায় সেটাই বাচ্চার খাবার হিসেবে যথেষ্ট।

মায়ের দুধ পানের সময় বাচ্চা মায়ের নিপল বা বোটা চুষলে মায়ের শরীরে এক ধরনের সুখানুভূতি সৃষ্টি হয়। বাচ্চার এ স্টিমুলেশন বা সুখানুভূতি মায়ের মস্তিষ্কে যায়। ফলে মায়ের শরীর থেকে এক ধরনের হরমোন তৈরি হয়। যার নাম প্রোল্যাকটিন। প্রোল্যাকটিনের কাজ হলো মায়ের বুকে দুধ তৈরি করা। বাচ্চা যত বুকের দুধ টানবে তত মায়ের সুখানুভূতি তৈরি হবে, তত প্রোল্যাকটিন উৎপাদন হবে। ফলে মায়ের বুকের দুধের পরিমাণ বাড়বে।
 
বাচ্চা কান্নাকাটি করলে অনেকে মনে করেন বাচ্চা দুধ ঠিকমতো পাচ্ছে না। তখন বাচ্চাকে মায়ের দুধ না দিয়ে কৌটার দুধ দেন। মায়ের বুকের দুধ টেনে খেতে বাচ্চার কিন্তু কিছুটা পরিশ্রম করতে হয়। এতে বাচ্চার ভালো হয়। তার মাঢ়ি, চোয়াল গঠিত হয়। কৌটার দুধ দিলে বাচ্চার কষ্ট করতে হয় না। তাই সে এক সময় মায়ের দুধ টেনে খাওয়া বন্ধ করে দেয়। বাচ্চা না দুধ টানলে মায়ের সুখানুভূতি হয় না এবং হরমোন তৈরি হয় না। ফলে মায়ের বুকের দুধ উৎপাদন কমে যায়।
 
আরেকটা জিনিস  মাকে খুব অস্থির করে রাখা হয়, বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে না, না খেতে পারলে বাচ্চার কি হবে, তখন নতুন মায়েরা খুব প্যানিক হয়ে যায়। এই জিনিসটা কিন্তু সম্পূর্ণ একটা সার্কেল বা রিদমের ব্যাপার। বাচ্চা যখন মায়ের বুকে সাক করবে, সেখান থেকে রিফ্লেক্স যাবে ব্রেইনে, ব্রেইন থেকে হরমোন আসবে, দুধ তৈরি হবে এবং নিপল এর মাধ্যমে বাচ্চার কাছে যাবে। যখনই সেখানে হরমোন, নার্ভাল সিস্টেম সবকিছু ইনভলভ থাকে, তখন কিন্তু একটা মাকে পরিবারের সদস্যরা সাপোর্ট দিয়ে স্ট্রেস-ফ্রি রাখতে হবে। মাকে কোনো স্ট্রেসের মধ্য দিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।
 
এমনিতেই নতুন মা হয়েছে, জীবনের একটা নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। সবকিছুতে তার মানিয়ে নিতে অসুবিধা হবে। তার মধ্যে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজনরা যদি তাকে স্ট্রেস দিতে থাকে, তখন এই স্ট্রেসফুল কন্ডিশন নতুন মাকে অনেক খানি বাধা দেয়। এটা লাক্টেশন ফেইলিওরের অনেকখানি কারণ।
মায়েদের সাহস দিতে হবে এসময়। মা কে বোঝাতে হবে যে এই বিষয়গুলো স্বাভাবিক। যদি অস্বাভাবিক কিছু হয় তাহলে আমরা ডাক্তার, নার্স তাদের হেল্প নিতে হবে।

একনজরে শিশুকে শাল দুধ খাওয়ানোর উপকারিতা:

১. শালদুধ শিশুর জীবনের প্রথম টিকা হিসেবে কাজ করে ।
২. শালদুধ আমিষ সমৃদ্ধ এবং এতে প্রচুর ভিটামিন-এ আছে।
৩. এতে আছে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ।
৪. শালদুধ শিশুর পেট পরিষ্কার করে এবং নিয়মিত পায়খানা হতে সাহায্য করে।  
৫. শিশুর জন্ডিস হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় ।
বুকের দুধ: আছে মা ও শিশুর উপকার
বুকের দুধ খেলে শুধুমাত্র যে শিশুর উপকার আছে তা নয়। এতে আছে মায়ের উপকারও।

ক. একনজরে শিশুর উপকার:
 
১. মায়ের দুধে শিশুর প্রয়োজনীয় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান থাকে সঠিক মাত্রায়। আর তাই, ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধই শিশুর জন্য যথেষ্ট । মায়ের দুধে পুষ্টি উপাদান ছাড়াও আছে শতকরা ৯০ ভাগ পানি। সেই জন্য শিশুকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত আলাদা পানি দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
২. বুকের দুধ পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত। বায়ু বা পানিবাহিত জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ নেই। মায়ের দুধে আছে শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মার উপাদান। ফলে শিশুর অসুখ বিসুখ বিশেষ করে ডায়রিয়া, কান পাকা রোগ, নিউমোনিয়া, শ্বাসনালীর রোগ, হাঁপানি, এলার্জি,  চুলকানি ইত্যাদি সংক্রমণের আশঙ্কা কমে যায়।

৩. শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মায়ের দুধ উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে,  যে সব শিশু কৌটার দুধ খায় তাদের তুলনায় মায়ের দুধ যারা খায় তাদের বুদ্ধির বিকাশ বেশি হয়।
৪. রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি থাকার ফলে অসুস্থ হলেও শিশু তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায়।
৫. মায়ের দুধ শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে দেয়।
৬. মায়ের দুধ সহজে হজম হয় । প্রাথমিক অবস্থায় শিশুর দেহ জটিল খাবার হজম করতে পারে না। কিন্তু মায়ের বুকের দুধের উপাদান সহজে হজম হয়।
৭. মায়ের দুধে পূর্ণমাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ থাকে বলে শিশুর রাতকানা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
৮. পরবর্তীতে শিশুর ক্যানসার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি ভয়াবহ রোগ হাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
 

খ. একনজরে মায়ের উপকার: 

১. জম্মের পরপরই শিশুকে বুকের দুধ দিলে মায়ের প্রসবজনিত রক্তপাত বন্ধ হয়। পরবর্তীতে রক্তস্বল্পতা হয় না। গর্ভজনিত স্ফীত জরায়ু দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
২. শিশুকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
৩. যেসব মা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ান তাদের স্তন, জরায়ু এবং ডিম্বকোষের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
৪. ৫ মাস বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ালে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং ২ বৎসর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ালে ঘন ঘন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
৫. বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। শিশুর সঙ্গে মায়ের আত্মিক বন্ধন দৃঢ় হয়।
৬. মায়ের দুধ নিরাপদ, ঝামেলামুক্ত এবং মায়ের বাড়তি খাটুনি ও সময় বাঁচায় এবং অর্থের সাশ্রয় হয়।