• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

ইসলামে আমানত রক্ষা করার গুরুত্ব

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ১৯ আগস্ট ২০২১  

কোনো ব্যক্তির কাছে কোনো বস্তু গচ্ছিত রাখলে তাকে বলা হয় আমানত। আমানতের বস্তু মালিকের সানন্দনুমতি ব্যতীত ব্যবহার করলে বা ভোগ করলে তা হবে খেয়ানত। খেয়ানত করা হারাম। মহানবী (সা.) খেয়ানতকে বলেছেন মুনাফিকের লক্ষণ। হাদিসে বর্ণিত কিয়ামতের আলামতগুলোর মধ্যে একটি হলো, মানুষ আমানতের বস্তুকে গনিমতের বস্তুর মতো ব্যবহার করবে। মহানবী (সা.) তার সমাজের মানুষের কাছে এতটাই বিশ্বস্ত আমানতদার ছিলেন যে, তার জানের দুশমনরাও তার কাছে মাল আমানত রাখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করত ও নিরাপদ মনে করত।

বিশিষ্ট তাফসিরবিদ আল্লামা কুরতুবি (রহ.)-এর দৃষ্টিতে আমানতদারির বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক। ইসলামি জীবনপদ্ধতির সব কিছুর সঙ্গে আমানতদারির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনা, সরকারি ও বেসরকারি দাফতরিক কাজকর্ম, শিক্ষকতা, সমাজের নেতৃত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য, মজুরি, শ্রম-মেহনত, দেশপ্রেম ইত্যাদি সবই আমানত।

সাধারণত আমরা মনে করি শুধু নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত আদায় করলেই জান্নাতে যাওয়া যাবে, আসলে বিষয়টি এমন নয়। এ ছাড়া আরো কিছু বিষয় আছে, যেগুলো আমরা খুব হালকা মনে করি, অথচ এ বিষয়গুলোই মানুষের জান্নাতে যেতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এবং এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিলে ইহকালীন ও পরকালীন সফলতা অর্জন করা যাবে।

আমানতের বিপরীত হলো খেয়ানত। কোনো দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নৈরাজ্য, দেউলিয়াপনা, অকার্যকরতা সৃষ্টি হয় আমানতকারীর অভাবে এবং খেয়ানতের কারণে। মানুষ যখন আমানতদারিকে বিসর্জন দিতে থাকে এবং খেয়ানতকে আসল সম্বল হিসেবে গ্রহণ করে তখন তার বিপর্যয় ঘটতে থাকে।

ইসলামে আমানত রক্ষার বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আর যারা নিজেদের আমানত ও অঙ্গীকারের প্রতি যত্নবান' (সূরা আল মুমিনুন, আয়াত :৮)।

আমানত রক্ষার গুরুত্ব বুঝাতে যেয়ে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমানত রক্ষা করে না, তার কোনো ঈমান নেই। যে ব্যক্তি কথা রক্ষা করে না তার কোনো দ্বীন নেই। ’ -সুনানুল বায়হাকি কুবরা: ১২৪৭০

‘যে ব্যক্তি কাউকে কিছু বলার সময় এদিক-সেদিক তাকায় (লক্ষ্য করে, অন্য কেউ শোনল কি-না) সে কথাও আমানত। ’ –সুনানে তিরমিজি: ১৯৫৯
‘পরামর্শও একটি আমানত। ’ –সুনানে আবু দাউদ: ৫১৩০ রাসূলে কারিম (সা.) একদিন হঠাৎ করে মদিনার বাজারে ছুটলেন। এক লোক গম বিক্রি করছিল খোলা বস্তায়, রাসূল (সা.) গিয়ে তাতে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। হাত বের করে দেখলেন হাত ভিজে গেছে। রাসূল (সা.) বুঝলেন, ওপরের গম শুকনো আর ভেতরেরগুলো ভিজা। রাসূল (সা,) জিজ্ঞাসা করলেন, কেন তুমি এই কাজ করলে? বিক্রেতা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কালকে রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। রাসূল (সা.) বলেন, তুমি ভেতরেরগুলো ওপরে না রেখে ভেতরে কেন রাখলে? এবং বলেন, যে ধোঁকাবাজি করবে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। (মুসলিম, হাদিস : ১০২)

আমরা জানি, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আমানত ও অঙ্গীকারের প্রতি যত্নবান ছিলেন আমাদের প্রিয় রাসূল, সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তার পবিত্র জীবনে এমন কোনো ঘটনা নেই যেখানে কেউ বলতে পারবে তিনি আমানতের খেয়ানত বা অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন। এই রাসূলের অনুসরণেই আমরা আল্লাহর ভালোবাসা লাভ করতে পারি। যেভাবে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, 'তুমি বলো, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে তোমরা আমাকে অনুসরণ করো। (এমনটি হলে) আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তিনি তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, বারবার কৃপাকারী' (সূরা আলে ইমরান, আয়াত :৩১)। আল্লাহের এই ওয়াদা শুধু মহানবীর (সা.) যুগের জন্যই সীমাবদ্ধ নয় বরং এই ঘোষণা চিরস্থায়ী। আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করতে হলে মহানবীর (সা.) অনুসরণ, অনুকরণ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মাধ্যম নেই। প্রিয় নবী (সা.) আমানতদার ছিলেন। অথচ আজ আমরা প্রতিনিয়ত আমানতের খেয়ানত করছি। অথচ মহানবী (সা.) চরম কঠিন অবস্থায়ও আমানতের খেয়ানত করেননি।

পবিত্র কোরআনের উপর সবচেয়ে বেশি আমলকারী ছিলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। মহানবীর (সা.) আমানত রক্ষার বিষয়ে আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করছি। আমাদের নবীর (সা.) ওপরও আপত্তি করা হয় যে, তিনি (সা.) ইসলাম প্রচারের জন্য যুদ্ধ করেছেন অথবা নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধের সময়ও রাসূল (সা.) আমানতের যে উত্তম দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন ইতিহাস এর সাক্ষী। যখন ইসলামী সেনাদল খায়বার ঘিরে ফেলল, তখন সে সময় সেখানকার এক ইহুদি নেতার এক কর্মচারী যে তার পশু চরাত সে পশুর পালসহ ইসলামী সেনাদলের এলাকায় এলো এবং মুসলমান হয়ে গেল। সে রাসূলের (সা.) খেদমতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, 'হে আল্লাহর রাসূল, আমি তো এখন মুসলমান হয়ে গেছি, ফেরত যেতে চাই না, এই ছাগলপাল আমার কাছে রয়েছে, এগুলো এখন কী করব আর এর মালিক ইহুদি। তিনি (সা.) বলেন, এই ছাগপালের মুখ কেল্লার দিকে ঘুরিয়ে হাঁকিয়ে দাও। তারা নিজেরাই তাদের মালিকের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। অতএব, তিনি এমনটিই করলেন আর কেল্লার মালিক ছাগপালকে কেল্লার ভেতর নিয়ে গেল।

এটি হলো আমানতের সেই অনুপম দৃষ্টান্ত, যা তিনি (সা.) প্রতিষ্ঠা করেছেন। এমন কঠিন অবস্থায় রাসূলের (সা.) অনুভূতি এমনই ছিল যে, এক ব্যক্তি যাকে কারও সম্পদের আমিন বানানো হয়েছে আর সে এখন মুসলমান হয়েছে। সে মুসলমান হয়ে খেয়ানত করবে, এটা কখনও হতে পারে না। তিনি (সা.) তাকে ইসলাম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম শিক্ষা এটিই দিলেন যে, আমানতের কখনোই খেয়ানত করবে না। অবস্থা যাই হোক না কেন, তোমাদের খোদা তায়ালার এই আদেশ সব সময় পালন করতে হবে যে, তোমরা নিজেদের আমানতের প্রতি যত্নবান হও, তা পুরোপুরি ফেরত দাও, এটির প্রতি কখনও অবহেলা প্রদর্শন করো না। সে সময়ে যুদ্ধ হচ্ছিল, মুসলমানদেরও খাবারের প্রয়োজন ছিল আর সেসব ছাগল তাদের কাজে আসত। এরপরও তিনি (সা.) বলেন, এমনটি করো না, এটি অবৈধ, এটি খেয়ানত আর অবৈধভাবে নেয়া সম্পদ মুসলমানদের জন্য হারাম। সুতরাং এই শিক্ষা ও আদর্শই তিনি (সা.) আমাদের দিয়েছেন।

হাদিসে আছে, হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) বর্ণনা করেন- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'তোমাদের কাছে কোনো জিনিস যে ব্যক্তি গচ্ছিত রেখেছে, তার গচ্ছিত জিনিস তাকে ফেরত দাও, বরং তার সঙ্গেও প্রতারণামূলক আচরণ করো না, যে তোমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে' (আবু দাউদ, কিতাবুল বাইউ)। ইসলামের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, যুবক বয়সেই মহানবীর (সা.) আমানত এতটা প্রসিদ্ধ ছিল যে, মক্কার কুরাইশরাও তাকে (সা.) 'আমিন' নামে ডাকত। এমনকি তার (সা.) নবুয়ত লাভের পরও যখন বিরোধিতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে এবং মক্কায় বসবাসকারী নেতারাও তার (সা.) বিরোধী ছিল, তখনও তারা রাসূলের (সা.) কাছে তাদের আমানত গচ্ছিত রাখত। কেননা তারা জানত যে, তিনিই একমাত্র আমানতদার ব্যক্তি, যার কাছে আমাদের গচ্ছিত আমানত কখনও নষ্ট হবে না।

রাসূল (সা.) তার প্রিয় উম্মতকে এমন চারটি বিষয়ে সতর্ক করেছেন, যেগুলোকে গুরুত্ব দিলে সেই উম্মত উভয় জাহানের সফলতা অর্জন করতে পারবে : আমনত রক্ষা করা : ‘হিফজু আমানাতিন’ অর্থাৎ বান্দার মধ্যে যার ওপর আমার হক আছে তা আমানতের সঙ্গে আদায় করা। আমানতের ব্যাপারে কারো সঙ্গে প্রতারণা না করা। কারো আমানত নিজের কাছে থাকলে তা তার কাছে যথাযথ পৌঁছে দেওয়া।
 
সত্য কথা : ‘সিদকু হাদিছিন’ অর্থাৎ সর্বদা সত্য কথা বলা। মুখ থেকে যেন কোনো মিথ্যা অবাস্তব, এবং ধোঁকাবাজির কথা বের না হয়। উত্তম চরিত্র : ‘হুছনু খালিক্বাতিন’, সর্বোচ্চ উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া। অর্থাৎ যে চরিত্র দেখলে আল্লাহও খুশি, বান্দাও খুশি হয়।

হালাল রিজিক : ‘রিজকে হালাল’ উপায়ে রিজিক অন্বেষণ করা, অর্থাৎ হালাল উপায়ে রিজিক উপার্জন করা। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমার উম্মত যদি আমার থেকে এই চারটি জিনিস নিতে পারে, তাহলে দুনিয়া ও আখিরাত তার হাতের মুঠোয় এসে পড়বে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৬৬৫২)
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে মহানবীর (সা.) জীবনাদর্শ অনুসরণ করে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।