• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

মিতব্যয়ী হও, অপচয়কারী নয়

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১  

সম্পদ ব্যয়ে মিতব্যয়ী হওয়ার উপকারিতা ও মোমিনের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না এবং তারা আছে এ দুইয়ের মধ্যমপন্থায়।’এ কারণেই মিতব্যয় মানুষের সর্বোত্তম গুণ। আর মিতব্যয়িতার মাধ্যমেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব। আল্লাহ তায়ালাও অপব্যয়কে বর্জন করে মিতব্যয়ী হওয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন।

ইসলাম ধর্মে মিতব্যয়িতার তাগিদ :
দৈনন্দিন জীবনে ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বনই মিতব্যয়িতা। অর্থাৎ কৃপণতা না করে প্রয়োজনমতো অথবা হিসাব করে ব্যয় করা। মিতব্যয় মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি করে এবং অন্যকে সাহায্য করার পথ উন্মুক্ত করে। মিতব্যয়ীরা কখনোই নিঃস্ব হয় না। মিতব্যয়িতা ঈমানদারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনের সুরা ফুরকানের ৬৩ নম্বর আয়াত থেকে মহান আল্লাহ তাঁর দয়াপ্রাপ্ত মুমিনদের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। এগুলোর অন্যতম হলো মিতব্যয়িতা। ইরশাদ হয়েছে, ‘(রহমানের বান্দা তো তারাই) যারা অপব্যয়ও করে না, আবার কৃপণতাও করে না। তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬৭)

বর্তমানে বিশ্ববাসীকে মিতব্যয়িতায় উৎসাহিত করতে বিশ্বজুড়ে ৩১ অক্টোবর পালন করা হয় বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস। ইসলাম অপব্যয়, অপচয় ও কৃপণতার ব্যাপারে সতর্ক করে মিতব্যয়িতার নির্দেশ দিয়েছে বারবার। তবে তা শুধু এক দিনের জন্য নয়, সারা জীবনই মিতব্যয়িতার পথ অবলম্বন করা ইসলামের বিধান। এবং শুধু ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বনও নয়; বরং কথাবার্তা, হাঁটা-চলায়ও মধ্যমপন্থার নির্দেশ রয়েছে ইসলামে। ইরশাদ হয়েছে, ‘পদচারণে মধ্যবর্তিতা অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর নিচু করো।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৯)

সব ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি ত্যাগ করে ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যমপন্থা অবলম্বনের শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। পবিত্র কোরআনুল কারিমে মুসলমানদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, ‘এমনিভাবে আমি তোমাদের মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৪৩)

মানুষের প্রয়োজনীয় সব জীবনোপকরণ দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। রিজিক গ্রহণের পাশাপাশি অপচয় যেন না হয়, সে ব্যাপারেও সতর্ক করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আহার ও পান করো, আর অপচয় কোরো না; তিনি (আল্লাহ) অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩২)

উপচেপড়া অতিরিক্ত সম্পদ বা খাদ্যটুকু অপচয় না করে গরিবের শূন্য হাঁড়িতে ঢেলে দিলে একদিকে যেমন অপব্যয়ের গুনাহ থেকে বেঁচে যায়, অন্যদিকে শূন্য হাঁড়িগুলো প্রাণ ফিরে পায়। এ জন্য কোরআনুল কারিমে মিতব্যয়ীদের ‘রহমানের বান্দা’ হিসেবে অভিহিত করার পাশাপাশি অপচয়কারীদের শয়তানের ভাই হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আত্মীয়-স্বজনকে তার হক দিয়ে দাও এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও। আর কিছুতেই অপব্যয় কোরো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৬-২৭)

দুঃখজনক হলো, কিছু মানুষ ‘রহমানের বান্দা’ হওয়ার চেয়ে শয়তানের ভাই হওয়াটাকেই বেছে নিচ্ছে। অপচয় এখন আমাদের সমাজের আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার অপচয় যেন এক ফ্যাশন। একদিকে পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের এখনো নিয়মিত তিন বেলা খাবার জোটে না, অন্যদিকে পৃথিবীর মোট উৎপাদিত খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশই অপচয় হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, বছরে প্রায় ১৩০ কোটি টন খাদ্য অপচয় হয়। অপচয় হওয়া এ বিপুল পরিমাণ খাদ্যের এক-চতুর্থাংশও যদি বাঁচানো যেত, তাহলে তা দিয়ে ৮৭ কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মিটত। (যুগান্তর : ৬ জানুয়ারি, ২০১৮)

অপচয়ের পাশাপাশি অপব্যয় থেকে বেঁচে থাকতে হবে:
রাসূলে কারিম (সা.) অপব্যয়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে ছিলেন। একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) সাদ (রা.)-কে অজুর মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যয় করতে দেখে বলেন, ‘হে সাদ! অপচয় করছ কেন? সাদ (রা.) বলেন, ওজুতে কি অপচয় হয়? নবীজি (সা.) বলেন, ‘হ্যাঁ। প্রবহমান নদীতে বসেও যদি তুমি অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করো, তা অপচয়।’ (ইবনে মাজা, হাদিস : ৪২৫)

অপচয় যেমন মিতব্যয়িতার প্রতিবন্ধক, তেমনি অপব্যয়ও মিতব্যয়ী হওয়ার পথে অন্তরায়। কেউ জৌলুস প্রদর্শনে কিংবা অপ্রয়োজনীয় বিনোদনে খরচ করছে লাখ লাখ টাকা। আর তার পাশের একজন গরিব মানুষ হয়তো টাকার অভাবে ওষুধও কিনতে পারছে না। একজন মুমিনকে মনে রাখতে হবে, সঞ্চয় করতে গিয়ে যেন কৃপণের তালিকায় তার নাম না উঠে যায়, আবার যেন অপব্যয়কারীর তালিকায়ও নাম না ওঠে। কৃপণ না হয়ে ইসলাম নির্দেশিত খাতে খরচে কোনো রকমের দ্বিধাবোধ না করে।

মিতব্যয়ী হলে মহান আল্লাহ দারিদ্র্যমুক্ত জীবন দান করবেন—এমনটিই রাসূলে কারিম (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পরিমিত ব্যয় করে সে নিঃস্ব হয় না।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৭/৩০৩) অর্থাৎ যে ব্যক্তি অর্থব্যয়ে পরিমিতবোধের চর্চা করবে, অনটন তার নাগাল পাবে না। ইসলামের এ মহান শিক্ষা যথাযথ অনুসরণ না করার কারণেই আজ আমাদের অনেকে উপার্জনের যাচিত সুফল থেকে বঞ্চিত। লাখ লাখ টাকা প্রতি মাসে উপার্জন থাকলেও অভাব থেকেই যাচ্ছে।

প্রাচুর্যের সময় খরচের উৎসবে মেতে না উঠে হারাম খরচ সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে মিতব্যয়িতার পথ অবলম্বন করে উদ্বৃত্ত অর্থ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে হবে, যেন পরবর্তী সময়ে নিজের প্রয়োজনে অন্যের কাছে হাত পাতার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি না হতে হয়। পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি (কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সঙ্গে বেঁধে রেখে একেবারে ব্যয়কুণ্ঠ হয়ো না, আবার (অপব্যয়ী হয়ে) একেবারে মুক্তহস্তও হয়ো না, তাহলে তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে।’ (বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৯)

অপব্যয় ও অপচয় না করে আত্মীয়দের হক আদায় ও দান-সদকার পাশাপাশি সন্তানদের জন্য কিছু সঞ্চয় করাও ইসলামের শিক্ষা। সন্তানদের কারো মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়া নবীজি (সা.) কখনো পছন্দ করেননি। রাসূলে কারিম (সা.) বলেন, ‘তুমি তোমার উত্তরাধিকারীদের মানুষের করুণার মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদের সচ্ছল রেখে যাওয়া উত্তম।’ (বুখারি : ১/৪৩৫; মুসলিম : ৩/১২৫১)

আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির কল্যাণে মিতব্যয়ী হওয়ার প্রতি আত্মসচেতনাবোধ সৃষ্টি করা।জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থ সঞ্চয় করে। যে অর্থ ছাড়া মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ সম্ভব নয়। আবার কঠোর পরিশ্রমের হালাল রিজিক ছাড়া ইবাদাত-বন্দেগিও কবুল হয় না। তাই সম্পদের অপচয় না করে মিত্যবয়ী হওয়া প্রত্যেক মানুষে একান্ত কর্তব্য। কুরআন হাদিসের অনেক জায়গায় অপব্যয় ও কার্পণ্য ত্যাগ করে মিতব্যয়ী হওয়ার প্রতি গরুত্বারোপ করেছেন।মানুষের জীবনযাত্রায় মিত্যবয়ীর গুণটি খুবই জরুরি। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যম অবস্থা অবলম্বন করাই হলো মিতব্যয়িতা। তাই কোনো কাজে সীমাহীন ও মাত্রাতিরিক্ত কিছু না করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।