• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

গোপন গুনাহ মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১  

গোপন পাপ মানুষের ব্যাপক ধ্বংস ডেকে আনে। গোপনে গুনাহ করা খুবই জঘন্যতম অপরাধ। গোপন গুনাহ হলো, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে নেক আমল করে, সৎ কাজ করে এবং আল্লাহর সব বিধিবিধান মেনে চলে, কিন্তু গোপনে মানুষের আড়ালে গুনাহে লিপ্ত থাকে।

এমন ধরনের গুনাহ খুবই ভয়াবহ। গোপনে গুনাহগার ব্যক্তি মূলত জেনে-বুঝে গুনাহে লিপ্ত হয়। আর কেউ যখন জেনে-বুঝে গুনাহে লিপ্ত হয় তখন তার অন্তর থেকে তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয় বিদায় নেয়। অন্তর তাকওয়াশূন্য হয়ে পাথরের মতো শক্ত হতে থাকে। ফলে অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত হয় না। মোনাজাতে চোখের পানি আসে না। একপর্যায়ে কোনো আমলেই আর মন বসে না। ইবাদত করতে ভালো লাগে না। কোরআন তেলাওয়াত মধুর লাগে না। এভাবে ক্রমান্বয়ে সে ধ্বংস ও অধঃপতনের দিকে এগুতে থাকে। সে বাঁচতে চায়, কিন্তু বাঁচতে পারে না।

পর্যায়েক্রমে তার অবস্থা এতটা ভয়ানক হয় যে, সে ঈমানহারা অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যে, সারাজীবন নেক আমল করেছে, লোকে তাকে ভালো জানত, কিন্তু মৃত্যুর সময় ঈমান নসিব হয়নি। কেউ কেউ আবার ইসলামকেই অস্বীকার করে বসে। পরবর্তীতে অনুসন্ধান করে জানা যায়, মনুষ্যসমাজ তাকে ভালো জানলেও গোপনে মারাত্মক ধরনের গুনাহে লিপ্ত ছিল সে।

গোপন গুনাহের উপাদান:
বর্তমানে গোপন গুনাহের উপাদান অত্যধিক। হাতের কাছে, বালিশের পাশে গুনাহের অসংখ্য বস্তু। আধুনিক পৃথিবীতে প্রযুক্তির সয়লাবের পাশাপাশি গুনাহের সয়লাবও হয়েছে। যেখানে গুনাহ করলে কেউ কিছু জানতে পারে না। শয়তানের প্ররোচনায় অনেক বড় পরহেজগার মুত্তাকি কঠিনতম গুনাহে লিপ্ত হয়ে যায়। ইন্টারনেট গুনাহের রাশি রাশি উপাদেয় হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। প্রযুক্তির ভালো দিক যেমনি রয়েছে তেমনি অশ্লীল গান, মুভি, পর্ন ইত্যাদি খারাপের দিকও ঢের কম নয়। তাই গোপন গুনাহের আশঙ্কা থেকে খুব অল্প মানুষই নিরাপদ!

গোপন গুনাহের ভয়াবহতা:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি আমার উম্মতের কতক দল সম্পর্কে অবশ্যই জানি, যারা কিয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালা সমতুল্য নেক আমল নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন। সাওবান (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের নিকট বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে যাই। তিনি বললেন, তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতোই ইবাদত করবে। কিন্তু তারা এমন লোক, যারা একান্ত গোপনে আল্লাহর হারামকৃত কর্মে লিপ্ত হবে।’ (ইবনে
মাজা : ২/১৪১৮)

ইবনে রজব হাম্বল (রহ.) বলেন, বান্দার গোপন গুনাহ ও অবাধ্যতার কারণে মন্দ মৃত্যু হয়ে থাকে, যা মানুষ জানে না; চাই তা খারাপ কোনো আমল হোক বা অন্য কিছু। তার এ গোপন চরিত্রই তার মন্দ মৃত্যুর কারণ হয়।’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম: ১/১৭২)।

হজরত ইবনুল জাওযি (রহ.) বলেন, গুনাহ থেকে পরিপূর্ণরূপে বেঁচে থাকো; বিশেষত গোপন গুনাহ থেকে। কেননা, আল্লাহর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বান্দাকে তার নজর থেকে ফেলে দেয়। আল্লাহ ও তোমার মাঝে গোপনীয় বিষয় সংশোধন কর; তাহলে তিনি তোমার বহিরাগত বিষয় সংশোধন করে দেবেন।’ (সাইদুল খাতির : ২০৭) শায়খ ইবনুল আরাবি বলেন, সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত সে-ই, যে মানুষের সামনে ভালো আমল করে, কিন্তু যে মহান সত্তা তার শাহরগ থেকেও অধিক নিকটবর্তী, তার সামনে বদ আমল করে। (তারিখু দিমাশক : ৫/৩৫৬)

গোপন গুনাহ থেকে বাঁচার উপায়:
১. সর্বদা এ কথা অন্তরে জাগ্রত রাখা যে, আল্লাহ আমাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি আমাকে সর্বদাই দেখছেন। আমি যা করি, আমার প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর সামনে। এ ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর পর্যবেক্ষক।’ (সুরা নিসা : ১)

২. অন্তরের সঙ্গে মুজাহাদা করা, তার কুমন্ত্রণা দূর করা এবং আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, শপথ প্রাণের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন, তার। অতঃপর তাকে অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়। আর যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়। (সুরা শামস : ৭-১০)

৩. যে রাস্তাগুলো গুনাহের দিকে ধাবিত করে, সে রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেওয়া। তা এভাবে যে, একাকী না থাকা; বরং সবসময় অন্যদের মাঝে থাকা। পরিবার-পরিজন, স্ত্রী ও সন্তানদের মাঝে থাকা। যদি স্ত্রী থেকে দূরে থাকেন তাহলে স্ত্রীকে সঙ্গে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। আপনার স্ত্রীর মাধ্যমে নিজেকে পবিত্র রাখুন এবং আপনার মাধ্যমে আপনার স্ত্রীকেও পবিত্র রাখুন। আর যদি আপনি আপনার পরিবারের কাছেই থাকেন এবং তাদের সঙ্গে বসবাস করেন তাহলে আপনি তাদের থেকে দূরে যাবেন না। আপনি আপনার স্ত্রীকে ভালোবাসুন। তার মাধ্যমে আপনার প্রয়োজন পূরণ করুন। যখনই আপনার অন্তরে দেখার খায়েশ জাগবে কিংবা কোনো কিছু আপনার নজরে পড়ে যাবে তখনই আপনি শয়তানকে হারামের দিকে আপনাকে নিয়ে যেতে দেবেন না। বরং আপনি দেরি না করে হালালকে গ্রহণ করুন।

৪. সদা-সর্বদা দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকর কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। কারণ অবসর সময় মানুষের নষ্টের কারণ। এমন নষ্ট যার কোনো সীমা নেই।

৫. আল্লাহ তাআলার কাছে বেশি বেশি কান্নাকাটি করে দোয়া। তিনি যেন তার অবাধ্যতা, নাফরমানি ও সব ধরনের গুনাহ থেকে রক্ষা করেন।

৬. কিয়ামতের দিন গোপন গুনাহকারীদের আমলগুলো ধূলিকণার মতো উড়িয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করা। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমি আমার উম্মতের কিছু মানুষ সম্পর্কে জানি, যারা কিয়ামতের দিন তিহামার (বিখ্যাত পাহাড়) শুভ্র পর্বতমালা সমতুল্য নেক আমল নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন। সাওবান (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের কাছে বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হই। তিনি বললেন, তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতোই ইবাদত করবে। কিন্তু তারা এমন লোক, যারা একান্ত গোপনে আল্লাহর হারামকৃত কর্মে (গোপন গুনাহ) লিপ্ত হবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৪১৮)

৭. গুনাহ করার সময় এ কথা চিন্তা করা, কেউ কি দেখলে আমি এমন গুনাহ করতে পারতাম? এভাবে নিজের ভেতরের লজ্জাবোধ জাগ্রত করা। এ বিষয়ে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি তোমার পরিবারের কোনো প্রভাবশালী সদস্যকে যেমন লজ্জা পাও, আল্লাহকে (কমপক্ষে) তেমন লজ্জা করো।’ (মুসনাদুল বাজ্জার : ৭/৮৯)

৮. এ চিন্তা করা, গুনাহরত অবস্থায় যদি আমার মৃত্যু হয়, তাহলে কিভাবে আমি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করব? মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তিকে (কিয়ামতের দিন) ওই অবস্থায় ওঠানো হবে, যে অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করেছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২০৬)

৯. অবসরে জিকির ও ফিকিরে থাকার চেষ্টা করা। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে নিদর্শনাবলি রয়েছে বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষের জন্য। যারা দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে আর বলে, হে আমাদের রব! আপনি এগুলো নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। আপনি পবিত্র। আপনি আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯০-১৯১)।

১০. বেশি বেশি আল্লাহর নিকট দোয়া করা। যেন আল্লাহ নাফরমানি ও সব গুনাহ থেকে হেফাজত করেন। শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে হেফাজত করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে; বস্তুত আমি তো রয়েছি সন্নিকটেই। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করি, যখন তারা আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য, যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।’ (সুরা বাকারা : ১)

মহান আল্লাহ আমাদের গোপন গুনাহ থেকে বাঁচার তৌফিক দান করুন। আমিন।