• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

ইসলামের দৃষ্টিতে জ্যোতিষশাস্ত্র কী হারাম?

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

জ্যোতিষবিজ্ঞান বা এস্ট্রলজি একটি সায়েন্স। এটি হলো সায়েন্স অফ প্রোবাবিলিটিস বা পসিবিলিটিস। অর্থাৎ কী হতে পারে তা নিয়ে অভিমত, ব্যাখ্যা, পর্যালোচনা বা অনুমান—এটাই হলো জ্যোতিষবিজ্ঞান। আর ইসলামের দৃষ্টিতে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিশিষ্ট আলেমদের অভিমত ইতিবাচক-নীতিবাচক দুটিই আছে। আসুন জেনে নেই ইসলামের দৃষ্টিতে জ্যেতিষশাস্ত্র সম্পর্কে কী বলা হয়েছে।  

একমাত্র আল্লাহই পারেন ‘নিশ্চিতভাবে কোনোকিছু ঘটবে’ এটা বলতে, কোনো মানুষ তা পারে না। কিন্তু কেউ যখন কোনো সম্ভাবনার কথা বলে, বলে এটা হতে পারে, সেটা ঘটতে পারে, তখন তা নিয়ে কোনো বিতর্ক হওয়ার কথা না।

পবিত্র কোরআনের সূরা জ্বীনের ২৬-২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘গায়েব বা ভবিষ্যৎ শুধুমাত্র তিনিই জানেন, যদি না তিনি কাউকে জানান, যেমন তিনি রসুলদের জানিয়েছেন।’ অর্থাৎ জানার পথ খোলা আছে। তিনি যে কাউকে ইচ্ছা ভবিষ্যৎ জানাতে পারেন, যে কাউকে ইচ্ছা গায়েব জানাতে পারেন, এটা ওনার এখতিয়ারে। আর এটা আল্লাহর একটি আশ্বাসই যে, যে যা জানতে চায়, আল্লাহ সেই বিষয়ে তাকে জ্ঞান দান করেন।

আমাদের এখানে অতীতে জ্যোতিষচর্চা করতেন মূলত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা। তাই অনেকের  ধারণা জ্যোতিষ-বিজ্ঞান চর্চা করলে সে মুসলমান থাকবে না। সেইসাথে কোরআন-হাদীসের পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যার মাধ্যমে কট্টরপন্থী একশ্রেণীর আলেম এ বিষয়টিকে ধর্মীয় নিষেধের বেড়াজালে বন্দি করে ফেলেন। তারা গণকের ভাগ্য গণনার সাথে জ্যোতিষ বিজ্ঞানকে একাকার করে ফেলেন।

অথচ ইসলামের স্বর্ণযুগে যত বড় বড় পণ্ডিত ছিলেন—আল বেরুনী, ইবনে খালদুন, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, আল বাত্তানী, আল কিন্দি, আল আন্দালাসী, আল জারকালি, ইবনে বাজ্জা, ইবনে তোফায়েল, ইবনে আরাবী, ইব্রাহীম আল ফাযারি, আল ফারগানি, আল খারেজমি, আল তারাবি, ওমর খৈয়াম, ইবনে ইউনুস, উলুগ বেগ, নাসিরুদ্দিন আল তুসী প্রমুখ মুসলিম মনীষীগণ জ্যোতিষ বিজ্ঞানের চর্চা করেছেন।

কারণ, তাদের অনুপ্রেরণা ছিল পবিত্র কোরআনের বাণী—‘নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন-রাত্রির আবর্তনে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। তারা দাঁড়িয়ে, বসে বা শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে। তারা আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্য নিয়ে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয় এবং বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি কর নি’ (সূরা আলে ইমরান ১৯০-১৯১)। পবিত্র কোরআনের ৮৫ নং সূরাটির নাম ‘বুরুজ’, যার মানে রাশিচক্র। আরবি ভাষায় রাশিকে বুরুজ বলা হয়।

বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসা তখন ছিল বিশ্বের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানকার পাঠ্যতালিকায় ছিল এই ইলমে আল নাজ্জুমী যা একইসাথে এস্ট্রলজি এবং এস্ট্রনমি—দুটোকেই বোঝাতো। এমন কোনো মুসলিম পণ্ডিত ছিলেন না যিনি এস্ট্রলজিতে দক্ষ ছিলেন না। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে বেয়ার’স স্টার চার্ট বা বেয়ারের তারাতালিকা ব্যবহারের আগ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল ‘জিজ-ই-উলুগ বেগ’ বা উলুগ বেগের তারাতালিকা যা প্রণয়ন করেন মধ্যযুগের সবচেয়ে খ্যাতনামা মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী উলুগ বেগ। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে যত নক্ষত্রের নাম রয়েছে এর তিন ভাগের এক ভাগই হচ্ছে আরবি নাম।

পণ্ডিত আল বেরুনী ছিলেন সুলতান মাহমুদের রাজ-জ্যোতিষ। তিনি যখন সুলতান মাহমুদের দরবারে আসেন সুলতান তার জ্যোতিষ বিজ্ঞানে দক্ষতা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি আল বেরুনীকে বললেন, আগামীকাল আমি কোন দরজা দিয়ে সিংহাসনে প্রবেশ করব, তা বলতে হবে।

সিদ্ধান্ত হলো—আল বেরুনী সব হিসেব-নিকেশ করে তার সিদ্ধান্ত লিখে একটা খামে সিলগালা করে সুলতানকে দেবেন। সুলতান খামটি সিংহাসনে রেখে যাবেন। পরদিন সুলতান দরবারে এসে সবার সামনে তা খুলবেন। যথানিয়মে আল বেরুনী তার ছক কষে হিসেব করে তার ভবিষ্যদ্বাণী লিখে খাম সিলগালা করে সুলতানের হাতে দিলেন। সুলতান তা সিংহাসনে রেখে দরবার শেষ করে বেরিয়ে এলেন। এসেই হুকুম করলেন—দেয়াল ভেঙে রাতের মধ্যেই নতুন একটি দরজা নির্মাণ করতে হবে।

যথারীতি দরজা নির্মিত হলো। পরদিন সুলতান মাহমুদ নতুন দরজা দিয়ে হাসতে হাসতে দরবারে প্রবেশ করলেন। ভাবখানা এই যে, আল বেরুনীকে আজ ভালোভাবেই জব্দ করা যাবে। কারণ স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যমান তিনটি দরজার যে-কোনো একটির কথাই কাগজে লেখা থাকবে।

সুলতান সিংহাসনের দিকে এগিয়ে গেলেন। খামটি তুললেন। মন্ত্রীর হাতে দিলেন। খুলে পড়তে বললেন। মন্ত্রী খাম খুললেন। কাগজে লেখা আছে—সুলতান আজ নতুন একটি দরজা দিয়ে দরবারে প্রবেশ করবেন।
দরবারসুদ্ধ সভাসদরা বিস্ময়ে হা হয়ে গেলেন।

কবি হিসেবে বিখ্যাত হলেও ওমর খৈয়াম ছিলেন খোরাসানের রাজ-জ্যোতিষ। তিনি ‘তারিখ ই জালালি’ নামে নির্ভুল ক্যালেন্ডার তৈরি করেন। গ্রেগরী ক্যালেন্ডারের সাথে তুলনা করলেই খৈয়ামের গণনার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রচলিত গ্রেগরী ক্যালেন্ডার অনুসারে ৩৩৩০ বছরের গণনায় একদিনের পার্থক্য দেখা দেবে। অপরদিকে ওমরের ক্যালেন্ডার হিসেবে গণনা করলে ৫০০০ বছরে একদিনের তারতম্য দেখা দেবে।

ওমর খৈয়ামের জ্যোতিষ-জ্ঞান এত নির্ভুল ছিল যে, নিজের মৃত্যুর দিন-ক্ষণ সম্পর্কে তার ধারণা ছিল। ঐতিহাসিক শাহজুরির বর্ণনা  অনুসারে-‘মৃত্যুর দিন খৈয়াম রোজা রেখেছিলেন। মাগরিবের সময় হলে তিনি নামাজে দাঁড়ান। সেজদায় গিয়ে তিনি উচ্চস্বরে বলেন—আল্লাহ! যথাসাধ্য তোমাকেই চেয়েছি। আজ আমার মিনতি—তোমার করুণা ও ক্ষমা থেকে যেন বঞ্চিত না হই’। সেজদা থেকে তিনি আর উঠেননি।