• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

ওরা এখন ক্লাস মিস করে না

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ৭ নভেম্বর ২০১৮  

নড়াইল সদর উপজেলার গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শতাধিক ছাত্রী এখন সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে।

চার বছর আগে হাতে গোনা কয়েকজন ছাত্রী সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাতায়াত শুরু করে। এরপর এর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকে। বর্তমানে শতাধিক ছাত্রী নিয়মিত সাইকেলে নিয়ে যাতায়াত করে। এসব ছাত্রীরা তাদের বান্ধবীদেরকেও সাইকেলের পেছনে বসিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করে। ভ্যানের অপেক্ষায় এখন আর তাদের ক্লাসও মিস করতে হয় না। তাই আগের তুলনায় ফলাফলও অনেক ভালো।

নড়াইল শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার শেখহাটি ইউপির গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিদ্যালয়টিতে নড়াইল সদর ও যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। দুটি উপজেলার মালিয়াট, বাকলি, হাতিয়াড়া, গুয়াখোলা, হাতিয়াড়া, বেনাহাটি, কমলাপুরসহ এগারোটি গ্রামের ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করে। বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিনশ।

দুই জেলার সীমান্তবর্তী হওয়ায় এ এলাকাটি অনেকটা অবহেলিত এবং অধিকাংশ রাস্তাঘাট কাঁচা। ৫-৭ কিলোমিটার দূরের শিক্ষার্থীরা এ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। ৪-৫ বছর আগে ছেলেরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করলেও মেয়েদের ভ্যানে ও পায়ে হেটে স্কুলে আসা যাওয়া করতে হতো। দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের যৌথ প্রয়াসে মেয়েদের সাইকেল কিনে দেয়া হয়।

বাবা মায়ের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেয়া, স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে বখাটের উপদ্রবের মতো অনেক সমস্যারই সমাধান করে দিয়েছে এ বাইসাইকেল।

ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী শান্তনা গুপ্ত বলেন, আমার বাড়ি বাকলি গ্রামে। স্কুল থেকে দুরত্ব ৫ কিলোমিটার। এক সময়ে ভ্যানে ও পায়ে হেটে স্কুলে চলাচল করতাম। তখন ঠিকমতো ক্লাস ধরতে পারতাম না। বাবা মা অতিরিক্ত টাকা দিতেও অসুবিধা হতো। তখন আমরা কয়েকজন ছাত্রীরা মনে করলাম ছেলেরা যদি সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসতে পারে তাহলে আমরা পারবো না কেন? তখন থেকে স্যার ও আমাদের বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলে সাইকেল কেনার সিদ্ধান্ত নেই। বাড়িতে ও গ্রামের ফাঁকা জায়গায় সাইকেল চালানো শিখে আমরা কয়েকজন স্কুলে আসা যাওয়া শুরু করলাম।

নবম শ্রেণির ছাত্রী দীপ্তি পাঠক বলেন, আগে ভ্যানে করে স্কুলে আসতে হতো। তখন বাবা মায়ের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিতে হতো। ভ্যান না পাওয়ায় অনেক সময় নষ্ট হয়ে যেতো। কিন্তু এখন আর কোন সমস্যা হয় না। এখন আমরা নিয়মিত ক্লাস করতে পারি এবং পড়াশোনাও ভাল হচ্ছে। তবে সাইকেলে চালিয়ে যাতায়াতের সময় রাস্তার অন্যান্য যানবাহন সাইড দিতে চায় না। অনেকে ব্যঙ্গ করে’’।

স্কুল ছাত্রী সেজুতি রায় বলেন, ‘‘আমি ৫ কিলোমিটার দূর থেকে স্কুলে আসি। কিন্তু স্কুলে সাইকেল গ্যারেজ না থাকায় কিছুদিন আগে আমাদের বান্ধবীদের দুটি সাইকেল চুরি হয়ে যায়। স্কুলে একটি সাইকেল গ্যারেজ নির্মাণের প্রয়োজন’’।

ছাত্রী খুশি সিকদার বলেন, এই স্কুলে ১১টি গ্রামের ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করে। ছেলেদের মতো মেয়েরাও সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে। আমরা প্রথমদিকে সাইকেল চালাতে লজ্জ্বা পেতাম। এখন আমরা অনেক সাহসী। আমরা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাবো। এলাকার বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, নারী নির্যাতনসহ সমাজ থেকে সব প্রকার কুসংস্কার দূর করতে সকলে কাজ করে যাবো’’।

এ স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র সোহাগ গুপ্ত বলেন, আমাদের স্কুলের ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সাইকেল চালিয়ে আসে। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে বখাটেরা তাদের উত্যক্ত করার চেষ্টা করলে আমরা ছেলেরা প্রতিহত করি। অনেক সময় স্যারের সহযোগিতা এবং ওইসব বখাটেদের বাবা মায়ের সাথে আলোচনা করি’’।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ মন্ডল বলেন, গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত। এ স্কুলে প্রায় তিনশত ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। এর মধ্যে ১৪৩ জন ছাত্রী রয়েছে। এই স্কুলের মেয়েরা ৫-৭ কিলোমিটার দূর থেকে স্কুলে আসে। তাদের হেঁটে আসতে অনেক সময় লাগে এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যার কারণে ক্লাসে পাঠদানে মনোযোগী হতে পারে না। আমরা ও অভিভাবকরা চিন্তা ভাবনা করে মেয়েদের সাইকেল চালনায় অনুপ্রেরণা দিয়েছি। তাদেরকে বলেছি ছেলেরা যদি সাইকেল চালিয়ে আসতে পারে, তাহলে মেয়েরা কেন পারবে না।

তখন অভিভাবকদের সম্মতিতে ছাত্রীদের সাইকেল কিনে দেয় তাদের অভিভাবকরা। এখন ওরা নিয়মিত সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে। আমরা এখন ছেলে ও মেয়েদের আলাদাভাবে দেখি না। সাইকেল নিয়ে স্কুলে আসতে এখন সময় কম লাগছে, অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে এবং নিয়মিত ও সময়মত স্কুলে উপস্থিত হতে পারছে। যার কারনে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানও বেড়েছে। তিনি আরো বলেন, এ বছর ওই বিদ্যালয় হতে সব ছাত্রছাত্রীই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়ে শতভাগ পাশ করেছে। তবে অবকাঠামো সমস্যার জন্য সাইকেল রাখার জায়গা নেই এবং শিক্ষার্থীদের পাঠদানও ব্যাহত হচ্ছে’’।

স্থানীয় শেখহাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাপস পাঠক বলেন, গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াতের ঘটনাটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। এভাবে যদি অন্যান্য স্কুলের মেয়েরাও স্কুলে যাতায়াতের জন্য বাইসাইকেলকে বাহন হিসেবে বেছে নেয় তাহলে তাদের অর্থ, সময় সব কিছুই সাশ্রয় হবে।

পাশাপাশি পড়াশোনায় মনোযোগী হবে। বাইসাইকেল পরিবেশ বান্ধব। এতে পরিবেশ দূষিত হয় না। সব স্কুলের মেয়েরা সময় ও অর্থ সাশ্রয় এবং স্বাধীনভাবে চলাচলের জন্য বাই সাইকেলকে বাহন হিসেবে বেছে নিবে এই প্রত্যাশা করি। পাশাপাশি গুয়াখোলা স্কুলের সার্বিক উন্নয়নে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন’’।