• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

করোনা মহামারি আমাদের যে বার্তা দিয়ে যায়

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ২৫ মার্চ ২০২০  

 

সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের। যিনি এই বিশ্বজগতের প্রতিপালক। যিনি আমাদের জীবন ও মৃত্যুর একমাত্র নির্ধারক। যিনি আমাদের রিজিকদাতা। গোটা বিশ্বজগতে যার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। যিনি সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। যিনি সর্বদ্রষ্টা, সর্বজ্ঞানী। দরুদ পেশ করি মানবতার মুক্তিদূত, আখেরি নবি মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রতি। যিনি রাহমাতুল্লিল আলামিন হিসেবে এই ধরায় আগমন করেছিলেন।

গোটা পৃথিবীজুড়ে এখন সর্বত্র যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বিরাজমান, তা হলো করোনা ভাইরাস। আজকের আলোচনায় আমরা মূলত ৭টি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব- যা এই করোনা সংকট থেকে আমরা শিখতে পারি। কারণ ঈমানদার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ও করণীয় হলো, চারপাশের ঘটনাবলি থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের জীবনকে পরিচালনা করা।

চলমান এ সংকট থেকে আমরা প্রথম যে বিষয়টি শিখতে পারি তা হলো, আমাদের অনেক বেশি বিনয়ী ও বিনম্র হতে হবে। আমাদের এই মহামারি আবার যেন জানিয়ে গেল যে, আমরা কেউই শক্তিমান নই। একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই সর্বোচ্চ শক্তি ধারণ করে আছেন। কোনো মানুষই অতিমানব নয়, কারও হাতে বিশেষ কোনো ক্ষমতা নেই। এই পৃথিবীতে বসবাসরত ৭শ কোটি মানুষের সবাই একজন মহাশক্তিমানের নিয়ন্ত্রণেই আছে, আর তিনি হলেন আমাদের রব আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। করোনা ভাইরাসের প্রভাব নিয়ে একটু ভাবুন। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা যে দেশে আছে সেই চীন এবং মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষমতাবান রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল উন্নত ও অনুন্নত দেশ এই ভাইরাসের আক্রমণে এখন দিশেহারা। এত ক্ষমতা, এত বিত্ত আর এত প্রাচুর্য থাকার পরও এই দেশগুলো যে ভাইরাসের ভয়ে কাবু হয়ে আছে সেই ভাইরাসটি কিন্তু আয়তনে খুবই ক্ষুদ্র। এতটাই ক্ষুদ্র যে, বিজ্ঞানীরা করোনা ভাইরাসটিকে দেখে বুঝতেই পারেন না, আদৌ এটি জীবিত না কি মৃত। আর ভাইরাসটির আয়তন অন্য যে কোনো সৃষ্টির তুলনায় অনেক বেশি ছোট। দৈর্ঘ্যের দিক থেকে ভাইরাসটি ২০ থেকে ২২ ন্যানো মিটার। খালি চোখে দেখা তো দূরের কথা, সাধারণ মানের মাইক্রোস্কোপ দিয়েও এই ভাইরাসটি দেখা যায় না। এই ভাইরাসটি দেখতে হলে চাই ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ।

ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে দেখতে হলেও এর আকৃতিকে কমপক্ষে এক লক্ষ গুণ বাড়িয়ে নিয়ে তারপর দেখতে হয়। একটি চালের দানাকে যদি আমরা এভাবে লাখ গুণ বাড়িয়ে চিন্তা করি তাহলে তা রীতিমতো একটি মাঠের আকৃতি দখল করবে। তাহলে বুঝুন, ভাইরাসটির আকৃতিকে কতটা বাড়ানোর পর তা মানুষের দর্শন ক্ষমতার আওতায় আসে। রীতিমতো অবিশ্বাস্য। অথচ এই ক্ষুদ্র থেকেও ক্ষুদ্র ভাইরাসটির ভয়ে গোটা বিশ্ব এখন তটস্থ। আর মানুষের এই অসহায়ত্ব প্রমাণ করে যে, একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। একজন রব আছেন। তিনি সব কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করছেন। আবারও প্রমাণ হলো, বিজ্ঞানের এত এত অগ্রগতি, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা সাধনের পরও আমরা এখনো নিজের জীবনের গতিপথকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। অন্য কারও জীবন নিয়ন্ত্রণ করা তো অনেক দূরের কথা। তাই করোনা ভাইরাস আমাদের বার্তা দিচ্ছে আমাদের এই বিশ্বজগতের অসীম শক্তিমান স্রষ্টার সামনে বার বার আত্মসমর্পণ করতে হবে।

এই মহামারি থেকে দ্বিতীয় যে শিক্ষা আমরা পেতে পারি তা হলো, জীবন যেমন সত্য মৃত্যুও ঠিক তেমনিভাবে সত্য। কারণ, দুনিয়াবি ব্যস্ততায় লিপ্ত হয়ে আমরা প্রায়শই যেন ভুলে যাই যে আমাদের মৃত্যুবরণ করতে হবে। আমরা এমনভাবে জীবন উপভোগ করি, এমনভাবে পরিকল্পনা করি যেন মনে হয় মৃত্যু কখনোই আমাদের স্পর্শ করবে না। অথচ এই করোনা ভাইরাস আমাদের জানাচ্ছে, কোনো মানুষকেই অমরত্ব দান করা হয়নি। প্রত্যেকটি জীবন্ত প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ পেতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আমরা মৃত্যু সমন্ধে না ভাবলেই মৃত্যু আমাদের কাছে আসবে না- এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আল্লাহ আমাদের জীবন দিয়েছেন এবং তিনিই আমাদের মৃত্যু দান করবেন।

চারপাশে যখন করোনার মতো মহামারি আসে, পত্র-পত্রিকা টিভি খুললেই যখন আমরা মৃত্যুর খবর পাই, তখন আমাদের আবার যেন মনে পড়ে যে, মৃত্যু থেকে পালিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হতে হতে যাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেছে সেই অন্তরগুলো এই জাতীয় মহামারি দেখলে আবার কোমল হয়ে উঠতে পারে। আমাদের যাদের মন সবসময় দুনিয়া নিয়েই মশগুল থাকে, এই মহামারি সেই মনগুলোতে আখেরাতের চিন্তা প্রবেশ করিয়ে দেবে। আর যদি এই জাতীয় মহামারিতে আমাদের হৃদয় ও অন্তর আখেরাতমুখী হয়, তাহলে করোনা আমাদের জন্য গজব হবে না, বরং নেয়ামত হিসেবে গণ্য হবে। আমার তখন আবার বুঝব, দুনিয়া খুবই ক্ষণস্থায়ী, মৃত্যুই হলো চূড়ান্ত বাস্তবতা। আর আমরা কেউই জানি না, কখন কোন মুহূর্তে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য মৃত্যুর ক্ষণকে নির্ধারণ করে রেখেছেন। এজন্যই আবু বকর (রা.) বলতেন, ‘প্রতিদিন সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙে আমি বুঝতে পারি, আমি মৃত্যুর আরো কাছে চলে গেলাম।’

তৃতীয় যে শিক্ষা আমরা করোনা সংকট থেকে পাই তা হলো, কিছু মানুষ অন্য সবার থেকে আলাদা- এই প্রচলিত ধারণার আসলে কোনো ভিত্তি নেই। কেননা, বাস্তবতা হলো, এই ভাইরাস সকল মানুষকেই সমানভাবে আক্রমণ করছে। আমরা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব, মানুষে মানুষে ভেদাভেদের মতো যত ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে পড়ে আছি, করোনা মহামারি সেই ধারণাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। অমুক দেশ সেরা, অমুক দেশ সবচেয়ে বেশি উন্নত- এই ধারণাকে করোনা ইতোমধ্যেই গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ধনী-গরিব, শাসক-শাসিত, সাদা-কালো সবাই এ রোগে একইভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেক দেশের প্রধানমন্ত্রী, এমপি, মন্ত্রী, বড় বড় ব্যবসায়ী এরই মধ্যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। ডিগ্রি, উন্নত পাসপোর্ট বা সমৃদ্ধ ব্যাংক-ব্যালেন্স কাউকেই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারছে না।

আমরা সবাই এক আদমের সন্তান। আল্লাহ সব মানুষকে একই রক্তকণিকা দিয়ে, মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। কাউকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে আলাদা রাখার আর কাউকে গরিব দেশের বলে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। করোনা ভাইরাস সবাইকেই এক কাতারে নিয়ে এসেছে। সবাইকেই একই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় ফেলে দিয়েছে। মানুষের যে সর্বজনীনতা, এক পিতার সন্তান হিসেবে মানুষকে আল্লাহ যেভাবে সৃষ্টি করেছেন এই ভাইরাস তা যেন আবার প্রমাণ করে দিয়েছে। জ্ঞানপাপী আর মিথ্যা অহংকারীদের চোখে আঙুল দিয়ে করোনা ভাইরাস যেন সত্যকে নতুন করে প্রমাণ করে দিয়েছে। ইসলাম বরাবরই একথাই বলেছে যে, দুনিয়ায় যত মানুষ সবাই অহেতুক ভেদাভেদ করে। আল্লাহর কাছে সবাই সমান। আল্লাহর কাছে সেই শ্রেষ্ঠ যার তাকওয়া উঁচুমানের। তাকওয়ার ভিত্তিতেই আল্লাহ মানুষের মানকে বিচার করেন। এর বাইরে দুনিয়াবি অন্য কোনো যোগ্যতার কোনো মূল্য আল্লাহর কাছে নেই।

একটা গল্প শেয়ার করি। ইতিহাসের বইতে এই গল্পটি পাওয়া যায়- যদিও জানি না গল্পটি কতটা সত্য। একবার এক জালেম শাসক জনৈক আলেমকে নির্যাতন করার জন্য তার দরবারে নিয়ে আসলো। জালেম শাসকটি বারবার আলেমকে অপমান করে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় একটি মাছি বারবার ঐ শাসকের সামনে দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। ফলে সে খুবই বিরক্ত হয়ে পড়ছিল। তখন সেই শাসক আলেমকে প্রশ্ন করল, তুমি তো অনেক কিছু জানো। বল তো, আল্লাহ কেন মাছির মতো এই বিরক্তিকর প্রাণীটিকে সৃষ্টি করল? তখন আলেম উত্তর দিলেন, তোমার মতো অহংকারী ও ঔদ্ধত্য শাসকও একটি ছোট্ট মাছির কাছে কতটা অসহায়, তা প্রমাণ করার জন্যই আল্লাহ মাছির মতো ছোট ছোট কীটপতঙ্গ সৃষ্টি করেছেন।

এই মহামারি থেকে আমরা চতুর্থ যে শিক্ষাটি পাই তা হলো, এই দুনিয়া, এর যাবতীয় সম্পদ, প্রাচুর্য ও ক্ষমতা সফলতার কোনো মানদণ্ড নয়। কেননা, এমনও হতে পারে, নেককার ভালো মানুষগুলো করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। আবার অনেক পাপিষ্ঠ ও বাজে মানুষও এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বেঁচে যেতে পারেন। আর এতেই প্রমাণ হয় যে, এই দুনিয়া সবকিছুর চূড়ান্ত ফায়সালা নয়। এর বাইরেও হিসেব-নিকেষের জায়গা আছে। অনেক সময় নিষ্পাপ শিশুও এই রোগে মারা যেতে পারে। আবার জালেম ব্যক্তিও বেঁচে যেতে পারে। তাই, আল্লাহ কাউকে দুনিয়া থেকে বঞ্চিত করলেই আল্লাহ তার ওপর নাখোশ হয়ে আছেন, এমনটা বলা যাবে না। আবার কেউ যদি দুনিয়াতে আপাতদৃষ্টিতে অনেক কিছু পায়, তার ওপর আল্লাহ অনেক সন্তুষ্ট হয়ে আছেন, তাও ধরে নেওয়া যাবে না।

আল্লাহ তার প্রিয় কিংবা অপ্রিয় যে কোনো মানুষকেই দুনিয়ায় শাস্তি দিতে পারেন। আবার অনেক নেককার বা পাপী বান্দার কাছ থেকেও দুনিয়াকে কেড়ে নিতে পারেন। তাই দুনিয়াতে কে কী পেল বা পেল না, তা সফলতার মাপকাঠি নয়। চূড়ান্ত সফলতা নির্ধারিত হবে আখেরাতে।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা এমন ফ্যাসাদ থেকে বেঁচে থাক যা শুধু জালেমদের ওপরই তা পতিত হবে না, অন্য সবাইও এর শিকার হতে পারে। জেনে রেখ যে, আল্লাহর আজাব অত্যন্ত কঠোর।’ [সুরা আনফাল: ২৫]

তাই কোনো একটি বিপর্যয়ের মুখে পড়লেই আল্লাহ আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন- এমনটা বলা যাবে না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্লেগ বা এ জাতীয় মহামারিগুলো শুধু আজাব নয়, কিছু বান্দার জন্য তা রহমতেরও কারণ হয়।’ অর্থাৎ এ পৃথিবীর বিপর্যয় বা পরীক্ষাগুলো যেমন শাস্তি হতে পারে আবার নেয়ামতও হতে পারে। সুস্বাস্থ্য নিঃসন্দেহে নেয়ামত। আবার টাকা পয়সাও নেয়ামত। আবার ঠিকমতো কাজে না লাগালে এগুলো শাস্তির কারণও হয়ে যায়। তাই দুনিয়ার প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি কোনোদিনই সফলতার মানদণ্ড হতে পারে না।

পঞ্চম যে শিক্ষা আমরা পাই তা খুবই প্রাসঙ্গিক। এ মহামারির কারণে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক মানুষগুলো নতুন করে পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের গুরুত্ব অনুধাবন করবে। কেউ যদি অসুস্থ হয় তাহলে তার পাশে সবার আগে তার আত্মীয়রাই আসবে। আমাদের মধ্যে অনেকেই শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এটা ইসলামের শিক্ষা নয়। কোনো সভ্য সমাজও এই জাতীয় চিন্তাধারা অনুমোদন করে না। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরকে ভালোবাসার যেমন দরকার আছে ঠিক তেমনি আবার অপরের কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়ারও প্রয়োজন আছে। করোনা ভাইরাস একটি সুন্দর পরিবার, সুন্দর সমাজ, দায়িত্ববান সরকার ও প্রশাসনের গুরুত্বকে যেন নতুন করে প্রতিষ্ঠা করে।

ইসলাম পূর্ব আরব ছিল জাহিলিয়াতে আক্রান্ত। ইসলাম এসে সেখানে সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করে। আরব থেকে মধ্য এশিয়া, চায়না থেকে আন্দালুস হয়ে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল। কেননা ইসলাম মানুষকে শুধু ধর্মকর্মই শেখায়নি, একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা ও একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামোও বিনির্মাণ করেছে। ইসলাম বিশ্বকে খুলাফায়ে রাশেদার মতো শাসন উপহার দিয়েছে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স কীভাবে করতে হয় তাও শিখিয়েছে ইসলাম। এই মহামারি যেন মুসলিম সংহতি, একটি কার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং বিশ্বনীতির প্রয়োজনীয়তাকে নতুন করে আবার আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে।

করোনা সংকট থেকে ৬ষ্ঠ যে শিক্ষা আমরা পাই তা হলো, কদর বা তাকদির বলতে একটি বিষয় আছে। আমরা যা অনেকেই মানতে অস্বীকার করি। কিন্তু কদরে বিশ্বাস রাখা ইসলামের মৌলিক চেতনার দাবি। খেয়াল করে দেখুন, কেন অমুক দেশ আক্রান্ত হচ্ছে, আপনি কেন নয়? কেন আপনার পাশের মানুষটি আক্রান্ত হচ্ছে আপনি কীভাবে সুস্থ আছেন? এই বিষয়গুলো কোনো তামাশা বা খামখেয়ালির বিষয় নয়। একজন মানুষ সবধরনের সতর্কতা নিয়ে, মাস্ক পড়ে, দিনের মধ্যে শতবার হাত সাবান দিয়ে ধুয়েও করোনায় আক্রান্ত হতে পারে। আবার আরেকজন মানুষ করোনা আক্রান্ত শহরের মাঝখান দিয়ে অসতর্কভাবে হেঁটেও নিরাপদ থাকতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের ওপর যে কোনো বিপদই আসে তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।' [সুরা হাদিদ: ২২]

এর মানে এই নয় যে, আমার সতর্কতা গ্রহণ করব না। আমরা সবই করব। কিন্তু ভাগ্য নির্ধারণের বিষয়টি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেব। আমরা আল্লাহর কাছে দুয়া করব। নিজেদের ও দেশ ও জাতির হেদায়েত কামনা করব। কেননা, দুয়া হলো বিশ্বাসীদের হাতিয়ার, যার মাধ্যমে কদরের পরিবর্তন করা যায়। 

আমওয়াসের প্লেগ সম্পর্কে একটি বিবরণী সীরাত গ্রন্থগুলো থেকে পাওয়া যায়। এক দিন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) সিরিয়ার দিকে যাত্রা করলেন। অতঃপর যখন তিনি ‘সার্গ (সৌদি ও সিরিয়ার সীমান্ত) এলাকায় গেলেন, তখন তাঁর সাথে সৈন্যবাহিনীর প্রধানগণ- আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.) ও তাঁর সাথীগণ সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা তাঁকে জানান যে, সিরিয়া এলাকায় (প্লেগ) মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, তখন উমর (রা.) আমাকে বললেন, আমার কাছে প্রাথমিক পর্যায়ে যাঁরা হিজরত করেছিলেন সেই মুহাজিরদের ডেকে আনো। আমি তাঁদের ডেকে আনলাম। উমর (রা.) তাদের সিরিয়ায় প্রাদুর্ভূত মহামারির কথা জানিয়ে তাদের কাছে সুপরামর্শ চাইলেন। তখন তাঁদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হলো। কেউ বললেন, আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বের হয়েছেন। তাই তা থেকে ফিরে যাওয়াকে আমরা পছন্দ করি না। আবার কেউ কেউ বললেন, আপনার সাথে রয়েছেন অবশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও নবির সাহাবিগণ। কাজেই আমাদের কাছে ভালো মনে হয় না যে, আপনি তাঁদের এই মহামারির মধ্যে ঠেলে দেবেন।

উমর (রা.) বললেন, তোমরা আমার নিকট থেকে উঠে যাও। তারপর তিনি বললেন, আমার নিকট আনসারদের ডেকে আনো। সুতরাং আমি তাঁদের ডেকে আনলাম এবং তিনি তাঁদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। কিন্তু তাঁরাও মুহাজিরদের পথ অবলম্বন করলেন এবং তাঁদের মতোই তাঁরাও মতভেদ করলেন। সুতরাং উমর (রা.) বললেন, তোমরা আমার নিকট থেকে উঠে যাও। তারপর আমাকে বললেন, এখানে যে সকল বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবি আছেন, তাদের ডেকে আনো।

আমি তাঁদের ডেকে আনলাম। তখন তাঁরা পরস্পরে কোনো মতবিরোধ করলেন না। তাঁরা বললেন, আমাদের রায় হলো, আপনি লোকজনকে নিয়ে ফিরে যান এবং তাদের এই মহামারির কবলে ঠেলে দেবেন না। তখন উমর (রা.) লোকজনের মধ্যে ঘোষণা দিলেন যে, আমি ভোরে সওয়ারির পিঠে (ফিরে যাওয়ার জন্য) আরোহণ করব। অতএব তোমরাও তাই করো।
আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ (রা.) বললেন, আপনি কি আল্লাহর নির্ধারিত তকদির থেকে পলায়ন করার জন্য ফিরে যাচ্ছেন? উমর (রা.) বললেন, হে আবু উবাইদাহ! যদি তুমি ছাড়া অন্য কেউ কথাটি বলত! হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর এক তকদির থেকে বের হয়ে অন্য তকদিরের দিকেই ফিরে যাচ্ছি।

তার মানে কেউ যদি কোথাও থেকে সুস্থ হয় বা অসুস্থ হয় কিংবা সেখান থেকে বাঁচার জন্য অন্য কোথাও যায় আর সেখানেও যদি অসুস্থ হয় তাহলে ধরে নিতে হবে, এটাই তার কদরে ছিল। আবার কদর মানে এমনটাও নয় যে, আমরা সতর্কতামূলক কোনো ব্যবস্থা নিব না। বরং কদর মানে হলো সব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরও আমরা আল্লাহর ওপরই পূর্ণ ভরসা রাখব। সুরা তাওবার এই আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আপনি বলুন, আমাদের কাছে কিছুই পৌঁছাবে না, কিন্তু যা আল্লাহ আমাদের জন্য রেখেছেন তা ঠিকই আসবে। তিনি আমাদের কার্যনির্বাহক। আল্লাহর ওপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিত।’ [সুরা তাওবা: ৫১]

তাই করোনার এই সংকট থেকে আমাদের এই শিক্ষাই নেওয়া উচিত যে, কদরের ওপর আমাদের আস্থা ও ভরসা আরও অনেক বাড়াতে হবে।

সর্বশেষ যে শিক্ষাটির কথা বলব, তা শুধু করোনা নয়, বরং এ জাতীয় বৈশ্বিক যে কোনো মহামারির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেই শিক্ষাটি হলো, যে কোনো মূল্যে আমাদের ঈমানকে আবার ঝালাই করতে হবে। নবায়ন করতে হবে। আল্লাহর কাছে আমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে, ফিরে যেতে হবে- এই বোধটিকে আবার জাগ্রত করতে হবে। এ ধরনের মরণঘাতী রোগের একটি সাধারণ ইতিবাচক প্রভাব হলো, যারা অধার্মিক বা নাস্তিক, তারাও এ জাতীয় দুযোর্গে ধর্মপরায়ণ হয়ে যায়। আর কুরআনে আল্লাহ বেশ কয়েকটি আয়াতে বলেছেন, যখনই তিনি মানুষের ওপর দুর্যোগ নাজিল করেন, তাদের সংকটে ও উদ্বেগে অবতীর্ণ করেন, তখনই মানুষ তাঁকে স্মরণ করে। মনে রাখবেন, দুর্যোগে বা বিপদে পড়ে যখন মানুষ আল্লাহকে স্মরণ করে বা আল্লাহর কাছে ফিরে আসে, আল্লাহ কখনোই এ জাতীয় প্রত্যাবর্তনকে নিয়ে সমালোচনা করেন না।

বিপদে কোনো মানুষ যদি অপর মানুষের সাহায্য চায় তাহলে বরং সাহায্যকারী মানুষ সেই সাহায্যের কথা বার বার তুলে তার সমালোচনা করে, খোটা দেয়। এটা মানুষের বৈশিষ্ট্য কিন্তু এটা আল্লাহর ফিতরত নয়। কিন্তু আল্লাহ সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, মানুষ বিপদে পড়লে আমাকে স্মরণ করে কিন্তু যখন বিপদটা কেটে যায় তখন সে আবার আমাকে ভুলে যায়।

তাই বিপদের সময় আল্লাহকে ডাকা বা ঈমানকে সংহত করার মধ্যে কোনো দোষ নেই। বরং সত্যি কথা হলো, এমনটাই হওয়া উচিত। এটাই মুমিন ও মুসলিমদের দায়িত্ব। রাসুল (সা.) যখনই কোনো সংকটে পড়তেন তখনই তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। লম্বা সময় নিয়ে নামাজ পড়তেন। তাহাজ্জুদ পড়তেন। এটাই আমাদের দায়িত্ব। আমি বিপদে পড়ে আল্লাহকে ডাকছি- এমনটা ভেবে অপরাধবোধে ভুগবেন না। অপরাধ বোধ আপনার তখন হওয়া উচিত, যদি বিপদ কেটে গেলে আপনি আবার আল্লাহকে ভুলে দুনিয়াদারিতে ব্যস্ত হয়ে যান।

তাই এ জাতীয় বিপদের সময় নামাজ ও দুয়ার পরিমাণ বাড়ানো উচিত। আর যদি এ সংকট কেটে যায়, আমরা যদি এরপরও বেঁচে থাকি, তাহলে কখনোই যেন আমরা আল্লাহকে ভুলে না যাই। বরং আল্লাহকে আমরা শুকরিয়া জানাব, তাঁর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ হব কেননা এত বড় বিপদের পরও তিনি আমাদের হেফাজত করেছেন।

এই জাতীয় ফিতনা ও বিপর্যয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো আমাদের সতর্ক করা যাতে আমরা সময় ফুরানোর আগে আল্লাহর কাছে ফিরে আসি। আল্লাহ আমাদের ছোট ছোট বিপদ দিয়ে সতর্ক করেন যাতে আমরা বড় বিপর্যয় তথা জাহান্নামের আগুন থেকে আমরা নিজেদের মুক্ত রাখতে পারি। আল্লাহ কুরআনে জানিয়েছেন, ‘বান্দাকে শাস্তি দিয়ে তাঁর কোনো লাভ নেই।’ সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, এ জাতীয় বিপর্যয় পাঠিয়ে আল্লাহর কোনো ফায়দা নেই। এগুলো আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা হিসেবে। কারণ আল্লাহ আমাদের ভালোবাসেন। তিনি চান, আমরা সত্য পথে ফিরে যাই। তাঁর নির্দেশিত পথে চলি, হালাল কাজ করি, হারাম কাজ থেকে বিরত রাখি। হালাল খাবার খাই। হালাল পথে আয় করি। নামাজ ও দুয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি করি। আল্লাহর কাছে নিজেদের অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চাই। তাওবা করি। অনুশোচনায় লিপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই। ভবিষ্যতেও এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি থেকে নিজেদের সংযত রাখি।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এই মহামারি থেকে হেফাজতে থাকার তাওফিক দেন। আল্লাহর পাঠানো এই পরীক্ষা থেকে সতর্ক হয়ে ভবিষ্যতের জীবনকে ইতিবাচকভাবে গঠন করার সামর্থ্য দিন। আমিন।