• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

‘কর্ডন প্রথা’ বিরোধি আন্দোলনে গ্রেপ্তার বঙ্গবন্ধুর মুক্তি

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ২১ জানুয়ারি ২০২১  

সারাজীবন ধরেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সবার আগে তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন ভাতের অধিকার। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই তিনি উপলব্ধি করেন এ দেশের মানুষ শোষিত-বঞ্চিত হচ্ছে। 

জানা যায়, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ ভাগের পরপরই দেশের অভ্যন্তরে ধান-চাল চলাচলে ‘কর্ডন প্রথা’ চালু করা হয়। ‘কর্ডন প্রথা’ চালু করা হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব-বাংলার ১৭টি জেলাতে। যে সমস্ত জেলায় তখন ‘কর্ডন প্রথা’ চালু ছিল সেসব জেলার বাইরে কোনো ধান-চাল বেসরকারিভাবে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। প্রান্তিক চাষিদের জন্য লড়াই করতে গিয়েই তিনি ১৯৪৮-৪৯ সালে ‘দাওয়াল’ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

এ কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে আন্দোলন করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় এবং  ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২১ শে জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্তি পান। 

‘কর্ডন প্রথা’ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, বিস্তৃত আকারে তার ভাষায়, ‘সে সময় খাদ্য সমস্যা দেখা দিয়েছিল কয়েকটা জেলায়। বিশেষ করে ফরিদপুর, কুমিল্লা ও ঢাকা জেলার জনসাধারণ এক মহাবিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। সরকার কর্ডন প্রথা চালু করেছিল। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কোনো খাদ্য যেতে দেওয়া হতো না। ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার লোক, খুলনা ও বরিশালে ধান কাটার মৌসুমে দল বেঁধে দিনমজুর হিসেবে যেত। এরা ধান কেটে উঠিয়ে দিত। পরিবর্তে একটা অংশ পেত। এদের ‘দাওয়াল’ বলা হতো। হাজার হাজার লোক নৌকা করে যেত। আসার সময় তাদের অংশের ধান নিজেদের নৌকা করে বাড়ি নিয়ে আসত। ..

ফরিদপুর, ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার হাজার হাজার লোক এই ধানের ওপর নির্ভর করত। দাওয়ালরা যখন ধান কাটতে যায়, তখন সরকার কোনো বাধা দিল না। যখন তারা দুই মাস পর্যন্ত ধান কেটে তাদের ভাগ নৌকায় তুলে রওনা করল বাড়ির দিকে তাদের বুভুক্ষু মা-বোন, স্ত্রী ও সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য, যারা পথ চেয়ে আছে, আর কোনো মতে ধার করে সংসার চালাচ্ছে- কখন তাদের স্বামী, ভাই, বাবা ফিরে আসবে ধান নিয়ে, পেট ভরে কিছুদিন ভাত খাবে, এই আশায়- তখন নৌকায় রওনা করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পথ রোধ করা হলো। ‘ধান নিতে পারবে না, সরকারের হুকুম’, ধান জমা দিয়ে যেতে হবে, নতুবা নৌকাসহ আটক ও বাজেয়াপ্ত করা হবে। সহজে কি ধান দিতে চায়? শেষ পর্যন্ত সব ধান নামিয়ে লোকগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হলো। এ খবর পেয়ে আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব হলো না। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করলাম। সভা করলাম, সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎও করলাম কিন্তু কোনো ফল হলো না।...

এ রকমের শত শত ঘটনা আমার জানা আছে। এদিকে ফরিদপুর, ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার অনেক নৌকার ব্যবসায়ী ছিল যারা বড় নৌকায় করে ধান-চাল ওইসব জেলা থেকে এনে বিক্রি করত, তাদের ব্যবসাও বন্ধ হলো এবং অনেক লোক নৌকায় খেটে খেত তারাও বেকার হয়ে পড়ল। এদের মধ্যে অনেকেই আজ রিকশা চালায়। একমাত্র গোপালগঞ্জ মহকুমার কয়েক হাজার লোক খুলনা, যশোর ও অন্যান্য জায়গায় রিকশা চালিয়ে এবং কুলির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করতে লাগল। আমরা যখন ভীষণভাবে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলাম, সরকার হুকুম দিল ধান কাটতে যেতে আপত্তি নেই। তবে ধান আনতে পারবে না। নিকটতম সরকারি গুদামে জমা দিতে হবে এবং সেই গুদাম থেকে কর্মচারীরা একটা রসিদ দেবে, দাওয়ালরা দেশে ফিরে এসে সেই পরিমাণ ধান নিজের জেলার নিকটতম গুদাম থেকে পাবে। দাওয়ালরা ধান কাটতে না গেলে একমাত্র খুলনা জেলায়ই অর্ধেক জমির ধান পড়ে থাকবে, এ কথা সরকার জানত। ১৯৪৮ সালের শেষে অথবা ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে এই হুকুম সরকার দিল। দুঃখের বিষয়, ধান গুদামে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু অধিকাংশ দাওয়াল ফিরে এসে ধান পায়নি। কোনোরকম পাকা রসিদ ছিল না, সাদা কাগজে লিখে দিয়েই ধান নামিয়ে রাখত। সেই রসিদ নিয়ে দেশের গুদামে গেলে গালাগালি করে তাড়িয়ে দিত। অথবা সামান্য কিছু ব্যয় করলে কিছু ধান পাওয়া যেত। এতে দাওয়ালরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেল।

এই সময় একটা ঘটনা ঘটে গেল খুলনায়। ফরিদপুর জেলার দাওয়ালদের প্রায় দু’শ নৌকা আটক করল ধানসহ। তারা রাতের অন্ধকারে সরকারি হুকুম না মেনে ‘আল্লাহ আকবর’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে নৌকা ছেড়ে দিল ধান নিয়ে। দশ-পনেরো মাইল চলার পরে পুলিশ বাহিনী লঞ্চ নিয়ে তাদের ধাওয়া করে বাধা দিল, শেষ পর্যন্ত গুলি করে তাদের থামান হলো। দাওয়ালরা বাধা দিয়েছিল, কিন্তু পারেনি। জোর করে নদীর পারে এক মাঠের ভেতর সব ধান নামানো হয়েছিল এবং লোকদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও সরকারি গুদামে সে ধান ওঠেনি। পরের দিন ভীষণভাবে বৃষ্টি হয়ে সে ধান ভেসে যায়। আমি খবর পেয়ে খুলনা এলাম, তখনো অনেক নৌকা আটক রয়েছে ধানসহ। এ সময় দাওয়ালদের নিয়ে সভা করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাড়িতে শোভাযাত্রা সহকারে উপস্থিত হলাম। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন প্রফেসর মুনীর চৌধুরীর বাবা আবদুল হালিম চৌধুরী। তিনি আমার সঙ্গে আলাপ করলেন এবং বললেন, তার কিছুই করার নেই, সরকারের হুকুম। তবে তিনি ওয়াদা করলেন, সরকারের কাছে টেলিগ্রাম করবেন সব অবস্থা জানিয়ে। আমি দাওয়ালদের নিয়ে ফিরে আসলাম। আমি নিজেও টেলিগ্রাম করলাম। দাওয়ালদের বললাম, ভবিষ্যতে যেন তারা এভাবে আর ধান কাটতে না আসে, একটা বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত। (শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, প্রথম প্রকাশ ২০১২, পৃষ্ঠা-১০৩-১০৫)

এখানেই শেষ নয়, ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২১ শে জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু জেল থেকে বেরিয়ে তিনি আবার চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন যার জন্য তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জরিমানা করা হয়। কিন্তু তিনি এই জরিমানাকে অবৈধ ঘোষণা করে তা প্রদান করা থেকে বিরত থাকেন। 

এরই ধারাবাহিকতায় ২৬শে এপ্রিল ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম লীগ বিরোধী প্রার্থী শামসুল হক টাঙ্গাইলে একটি উপ-নির্বাচনে বিজয় লাভ করেন। শেখ মুজিব তার সেই আন্দোলনের সফলতার জন্য উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনশনের ধর্মঘট করেন যার জন্য তাকে পুণরায় আটক করা হয়। 

এ সময়েই তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করা। 

উল্লেখ্য যে, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই আগস্ট তার হৃত ছাত্রত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফিরিয়ে দেয়।

বাঙালি জাতির জনক, স্বাধীনতা বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম কারাবরণ সেই ছাত্রজীবনে, তখন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের দিন।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বইপত্র, প্রবন্ধ এবং নানা নথিপত্র ঘেঁটে তার কারাবাসের দিনগুলো সম্পর্কে জানা গেলেও ঠিক কতদিন তিনি জেলে ছিলেন সে বিষয়ে কোনো নথিতেই সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই।

তবে বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের রাজনৈতিক সচিব, আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ ২০১৭ সালের ৭ মার্চ জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, ৫৪ বছর বয়সের জীবনে বঙ্গবন্ধু চার হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন।

এর মধ্যে স্কুলের ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাতদিন কারাভোগ করেন বঙ্গবন্ধু, বাকি চার হাজার ৬৭৫ দিন তার জেলে কাটে পাকিস্তান আমলে।