• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

গান-বাজনার ব্যাপারে ইসলাম কী বলে?

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ১৯ জানুয়ারি ২০২০  

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআন মাজিদে বলেন,

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ

‘একশ্রেণির মানুষ আছে যারা মূর্খতাবশত মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার উদ্দেশ্যে লাহওয়াল হাদিস (অবান্তর কথাবার্তা, গান-বাজনা) সংগ্রহ করে এবং দীনকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ [সুরা লুকমান, ৩১ : ৬]

ইমাম ওয়াহিদি অন্যান্য তাফসিরকারগণের সাথে ব্যাখ্যা করেন যে, এই আয়াতে ‘লাহওয়াল হাদিস’ বলতে গান-বাজনাকে বোঝানো হয়েছে। যে সকল সাহাবা এই ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তারা হলেন, ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ, মুজাহিদ, ইকরিমা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)। ইবনু মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ, যিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, লাহওয়াল হাদিস হলো গান।’

• রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
‘আমার উম্মতের মধ্য হতে একদল লোক এমন হবে যারা ব্যভিচার, রেশমি বস্ত্র পরিধান, মদ পান এবং বাদ্যযন্ত্র হালাল মনে করবে। কিছু লোক এমন হবে যারা একটি পর্বতের নিকটে অবস্থান করবে এবং সন্ধ্যাবেলায় তাদের মেষপালক তাদের নিকট মেষগুলো নিয়ে আসবে এবং তাদের নিকট কিছু চাইবে, কিন্তু তারা বলবে, ‘আগামীকাল ফেরত এসো’। রাতের বেলায় আল্লাহ তায়ালা তাদের ধ্বংস করে দেবেন এবং তাদের ওপর পর্বত ধসিয়ে দিবেন, বাকি লোকদের তিনি বানর ও শূকরে পরিণত করে দেবেন এবং শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত তারা এই অবস্থায় থাকবে।’ [বুখারি, আসসাহিহ : ৪৯৪]

এই হাদিসে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, গান-বাদ্য হারাম। আর আলিমদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। ইবনুল কাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ‘ইগাসাতুল লাহফান’ গ্রন্থে বলেন, ‘যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘বৈধ মনে করবে’, তার মানে তিনি বুঝিয়েছেন এটা অবৈধ, এরপর লোকেরা একে বৈধ বানিয়েছে।’

• আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘একদল লোককে আল্লাহ তায়ালা বানর ও শূকরে পরিণত করে দেবেন।’ সাহাবাগণ আরজ করলেন, ‘তারা কি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এই সাক্ষ্য প্রদান করে?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হ্যাঁ, এমনকি তারা সিয়াম ও হজও পালন করে।’ সাহাবাগণ আরজ করলেন, ‘তাহলে, তাদের অপরাধটা কী হবে?’ তিনি বলেন, ‘তারা বাদ্যযন্ত্র, ঢোল ও নারী সঙ্গীতশিল্পী ব্যবহার করবে। (একদিন) তারা রাতভর মদ্যপান, হাসি তামাশা করে নিদ্রা যাবে, সকালে (আল্লাহর ইচ্ছায়) তারা বানর ও শূকরে পরিণত হবে।’ [ইবনুল কাইয়িম, ইগাসাতুল লাহফান]

• আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের কাবাঘরের চারপাশের ইবাদতের সমালোচনা করে বলেন,

وَمَا كَانَ صَلاَتُهُمْ عِندَ الْبَيْتِ إِلاَّ مُكَاء وَتَصْدِيَةً فَذُوقُواْ الْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْفُرُونَ

‘আর কাবার নিকট তাদের নামাজ বলতে শিস দেয়া আর তালি বাজানো ছাড়া অন্য কোনো কিছুই ছিল না। অতএব, এবার নিজেদের কৃত কুফরির আজাবের স্বাদ গ্রহণ করো।’ [সুরা আনফাল, ৮ : ৩৫]

ইবনু আব্বাস, ইবনু উমর, আতিয়াহ, মুজাহিদ, যাহহাক, হাসান এবং কাতাদাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘মুকা’ অর্থ শিস বাজানো, ‘তাসদিয়াহ’ অর্থ তালি বাজানো। কুরআন মাজিদের অন্য আয়াতে আছে, ইবলিস-শয়তান আদম সন্তানকে ধোঁকা দেওয়ার আরজি পেশ করলে আল্লাহ তায়ালা ইবলিসকে বললেন,

وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ وَأَجْلِبْ عَلَيْهِم بِخَيْلِكَ وَرَجِلِكَ وَشَارِكْهُمْ فِي الأَمْوَالِ وَالأَوْلادِ وَعِدْهُمْ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلاَّ غُرُورًا

‘তুই সত্যচ্যুত কর তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস স্বীয় আওয়াজ দ্বারা, স্বীয় অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে তাদের আক্রমণ কর, তাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতিতে শরিক হয়ে যা এবং তাদের প্রতিশ্রুতি দে। ছলনা ছাড়া শয়তান তাদের কোনো প্রতিশ্রুতি দেয় না।’ [সুরা বনি ইসরাইল, ১৭ : ৬৪]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত তাবিয়ি মুজাহিদ (রহ.) বলেন, ইবলিসের আওয়াজ বলতে এখানে গান ও বাদ্যযন্ত্রকে বোঝানো হয়েছে। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যেসব বস্তু পাপাচারের দিকে আহ্বান করে তার মধ্যে গান-বাদ্যই সেরা। এজন্যই একে ইবলিসের আওয়াজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। [ইগাসাতুল লাহফান, ১/১৯৯] 

বস্তুত গান-বাজনার ক্ষতিকর প্রভাব এত বেশি যে, তা নাজায়েয হওয়ার জন্য আলাদা কোনো দলিল খোঁজার প্রয়োজন পড়ে না। এতদসত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু হাদিসের মাধ্যমে তা প্রমাণিত।

• গান-গায়িকা এবং এর ব্যবসা ও চর্চাকে হারাম আখ্যায়িত করে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা গায়িকা (দাসী) ক্রয়-বিক্রয় কোরো না এবং তাদের গান শিক্ষা দিও না। আর এসবের ব্যবসায় কোনো কল্যাণ নেই। জেনে রেখ, এর প্রাপ্ত মূল্য হারাম।’ [তিরমিজি, আসসুনান : ১২৮২; ইবনু মাজাহ, আসসুনান : ২১৬৮] 

মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি নামে বর্তমানে গান ও বাদ্যযন্ত্রের যে বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে, যাতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে, এর সকল উপার্জন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস অনুযায়ী সম্পূর্ণ হারাম।

• রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও ইরশাদ করেন, ‘আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার ওপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা রমণীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের জমিনে ধসিয়ে দেবেন।’ [ইবনু মাজাহ, আসসুনান : ৪০২০; ইবনু হিব্বান, আসসাহিহ : ৬৭৫৮]

• আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) বলেন, ‘পানি যেমন (ভূমিতে) তৃণলতা উৎপন্ন করে তেমনি গান মানুষের অন্তরে মুনাফিকি সৃষ্টি করে।’ [ইবনুল কাইয়িম, ইগাসাতুল লাহফান, ১/১৯৩]

উপরোক্ত বাণীর সত্যতা এখন দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার। গান-বাজনার ব্যাপক বিস্তারের ফলে মানুষের অন্তরে এই পরিমাণ নিফাক সৃষ্টি হয়েছে যে, সাহাবিদের ইসলামকে এ যুগে অচল মনে করা হচ্ছে এবং গান-বাদ্য, নারী-পুরুষের মেলামেশা ইত্যাদিকে হালাল মনে করা হচ্ছে।

• বিখ্যাত তাবিয়ি নাফি (রহ.) থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার চলার পথে আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) বাঁশির আওয়াজ শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুই কানে আঙ্গুল দিলেন। কিছু দূর গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নাফি! এখনো কি আওয়াজ শুনছ?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’। এভাবে তিনি পথ চলতে থাকলেন। এক পর্যায়ে আমি যখন বললাম, ‘এখন আর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না’ তখন তিনি কান থেকে আঙ্গুল সরালেন এবং বললেন, ‘একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) চলার পথে বাঁশির আওয়াজ শুনে এমনই করেছিলেন।’ [আহমাদ, আলমুসনাদ : ৪৫৩৫]

একদিন আম্মাজান আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার নিকট বাজনাদার নুপুর পরে কোনো বালিকা আসলে আয়িশা (রা.) বললেন, ‘খবরদার, তা খুলে না ফেলা পর্যন্ত আমার ঘরে প্রবেশ করবে না।’ এরপর তিনি বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ঘরে ঘণ্টি থাকে সেই ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।’ [আবু দাউদ, আসসুনান :  ৪২৩১]

বাজনাদার নুপুর বা ঘুঙুরের আওয়াজও সাহাবায়ে কেরাম বরদাশত করতেন না। তাহলে গান ও বাদ্যযন্ত্রের প্রশ্নই কি অবান্তর নয়? রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ঘণ্টি, বাজা, ঘুঙুর হলো শয়তানের বাদ্যযন্ত্র।’ [মুসলিম, আসসাহিহ : ২১১৪]

মৃদু আওয়াজের ঘণ্টি-ঘুঙুরের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আধুনিক সুরেলা বাদ্যযন্ত্র আর উন্মাদনা সৃষ্টিকারী মিউজিকের বিধান কী হবে তা খুব সহজেই বুঝা যায়।