• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

ফেরাউনের শেষ পরিণতি ও আমাদের শিক্ষা

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ৬ এপ্রিল ২০২০  

 

‘ফেরাউন ও তার বাহিনী জমিনে অন্যায় অহমিকা প্রদর্শন করেছিল। তারা মনে করেছিল তাদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না। সুতরাং আমি তাকে ও তার সৈন্যদেরকে পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম। এবার দেখ, জালিমদের পরিণতি কী হয়ে থাকে! (সূরা : কাসাস ২৮ : ৩৯-৪০)।
‘ফেরাউন ও তার বাহিনী জমিনে অন্যায় অহমিকা প্রদর্শন করেছিল। তারা মনে করেছিল তাদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না। সুতরাং আমি তাকে ও তার সৈন্যদেরকে পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম। এবার দেখ, জালিমদের পরিণতি কী হয়ে থাকে! (সূরা : কাসাস ২৮ : ৩৯-৪০)।

বাদশাহ ফেরাউন। খোদা দাবিদার। অন্যায়ের বাদশাহ। আল্লাহর নবী হজরত মূসা (আ.) এর প্রতিপক্ষ। তার অন্যায়, জুলুম খোদায়ী দাবির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন নবী মূসা (আ.)। 
এক আল্লাহ ও সত্যের দাওয়াত পৌঁছে দিতে ফেরাউনের রাজ্যে দাওয়াত নিয়ে গেলেন। কিন্তু ফেরাউন অহংকারী হয়ে উঠলো। নিজের ক্ষমতা ও আধিপত্যের মোহে সে অন্ধ। ফলে আল্লাহর নবীকে মারতে যেয়ে নিজেই আল্লাহর ক্রোধে ধ্বংস হয়েছিলো।
  
কোরআনে বর্ণিত কাহিনীগুলোর মধ্যে হজরত মুসা (আ.) এর যুগে জালেম অত্যাচারী বাদশাহ ফেরাউনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আল্লাহর নাফরমানিতে সে এতই সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল যে, এক পর্যায়ে নিজেকে বড় রব ‘আনা রাব্বুকুমুল-আলা’ বলেও দাবি করেছিল। হজরত মুসা (আ.) এর তবলীগ প্রচারকে বারবার অমান্য এবং তার বিরুদ্ধাচরণ করা হয়। আল্লাহ তায়ালাও তাদের পরীক্ষার জন্য নানা আসমানি বালা নাজিল করতে থাকেন এবং সংশোধিত হওয়ার জন্য বারে বারে সময়ও দিতে থাকেন। 

ফেরাউনের কিবতি জাতি যখন কোনো বিপদ আপদের শিকার হত, হজরত মুসা (আ.) এর নিকট এসে দোয়া প্রার্থনা করত, যাতে তার দোয়ায় বালা-বিপদ কেটে যায়। মুসা (আ.) এর দোয়ায় তারা বিপদমুক্ত হয়ে ফের আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ত। কিন্তু একই সময় এই বিপদ হতে মুসা (আ.) এর বনি ইসরাইল মুক্ত থাকত, তাদের কোনো ক্ষতি হত না। এ পরিস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত করে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর, আমি তাদেরকে প্লাবন, পঙ্গপাল, উকুন, ভেক এবং রক্ত দ্বারা ক্লিষ্ট করি। (সূরা আরাফ, আয়াত-১৩৩)। এর পূর্বের আয়াতে বলা হয়, ‘এবং নিশ্চয় আমি ফেরাউন বংশকে দুর্ভিক্ষ ও ফল-শস্য হানির দ্বারা ধৃত করেছিলাম, যেন তারা হৃদয়ঙ্গম করে।’ (সূরা আরাফ, আয়াত : ১৩০)।

মিসরের বাদশাহ ফেরাউন যখন হজরত মুসা (আ.)-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল সেই সময়ে আল্লাহর আদেশক্রমে নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপদ তাদের চতুর্দিক হতে গ্রাস করে ফেলে। প্রথমেই ফেরাউনের অবাধ্যতার পরিণতিস্বরূপ দীর্ঘদিনব্যাপী আজন্মা শস্যহানি ও দুর্ভিক্ষে মিসরবাসী আক্রান্ত হয় এবং সমগ্র দেশ ক্ষুধার্তের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে। আল্লাহ তায়ালা বলেন যে, আল্লাহদ্রোহী ফেরাউন ও পথভ্রষ্ট মিসরবাসীর সত্য ধর্ম শিক্ষা দেয়ার জন্যই আমি তাদের ওপর র্সবপ্রথম এই শাস্তি প্রেরণ করেছিলাম।

এই দুইটি আয়াতে হজরত মুসা (আ.) এর প্রার্থনা অনুসারে ফেরাউন ও মিসরবাসীর ওপর যেসব ভয়াবহ শাস্তি (আজাব) অবতীর্ণ হয়েছিল তা-সহ ফেরাউনের হঠকারিতার সংক্ষিপ্ত আভাস প্রদান করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, ফেরাউনের অবাধ্যতার জন্য প্রথমে অজন্মা, শস্যহানি ও দুর্ভিক্ষে মিসর দেশ জর্জরিত হতে থাকে। কিন্তু ফেরাউন স্বীয় প্রজাসাধারণের করুণ ক্রন্দনে নিরুপায় ও বিষণ্ন হয়ে হজরত মুসা (আ.) নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। তার প্রার্থনা অনুসারে অজন্মা ও দুর্ভিক্ষ দূরীভূত হয়ে যায়। অনন্তর ফেরাউন পুনরায় বিদ্রোহ ও অত্যাচার আরম্ভ করায় হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে স্বীয় লাঠির দ্বারা নদীর পানিতে আঘাত করলেন। যার দ্বারা সমগ্র মিসরে জলাশয় ও জলধারাসমূহ জলাশয় ও জলধারাসমূহ তরল শোণিত স্রোতে পূর্ণ হয়ে যায় এবং যাবতীয় মৎস্য ও জীবজন্তু মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে এক অসহ্য দুর্গন্ধে সমস্ত দেশ আচ্ছন্ন করে ফেলে। তবুও তারা ফিরে আসেনি। দিন যায় রাত আসে। ফেরাউনের ঔদ্ধত্য বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে মূসা নবী ও তার দলবলকে হত্যা করতে ধাওয়া করে। পথিমধ্যে মিশরের নীল নদ দিয়ে মূসা নবী ও বনী ঈসারাঈল অলৌকিভাবে পার হয়ে যায়। ডুবে মারা যায় ফেরাউন। বিশ্ববাসীর জন্য আজও ফেরাউনের লাশ দৃষ্টান্তস্বরূপ সংরক্ষিত রয়েছে। পবিত্র কোরআনুল কারিমে এসব ঘটনা এভাবে বিবৃত হয়েছে,

وَلَقَدْ أَخَذْنَا آَلَ فِرْعَوْنَ بِالسِّنِينَ وَنَقْصٍ مِنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ

‘আমি ফেরাউনের সম্প্রদায়কে দুর্ভিক্ষ ও ফসলাদির ক্ষতির দ্বারা আক্রান্ত করেছি, যাতে তারা সতর্ক হয়।’ (আরাফ ৭ : ১৩০)।

إِنَّ فِرْعَوْنَ عَلَا فِي الْأَرْضِ وَجَعَلَ أَهْلَهَا شِيَعًا يَسْتَضْعِفُ طَائِفَةً مِنْهُمْ يُذَبِّحُ أَبْنَاءَهُمْ وَيَسْتَحْيِي نِسَاءَهُمْ إِنَّهُ كَانَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ

‘ফেরাউন জমিনে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল এবং সে তার অধিবাসীদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল। তাদের একটি শ্রেণীকে সে অত্যন্ত দুর্বল করে রেখেছিল, যাদের পুত্রদের সে যবাই করত ও নারীদেরকে জীবিত রাখত। প্রকৃতপক্ষে সে ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী।’ (কাসাস ২৮ : ৪)।

وَقَالَ الْمَلَأُ مِنْ قَوْمِ فِرْعَوْنَ أَتَذَرُ مُوسَى وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآَلِهَتَكَ قَالَ سَنُقَتِّلُ أَبْنَاءَهُمْ وَنَسْتَحْيِي نِسَاءَهُمْ وَإِنَّا فَوْقَهُمْ قَاهِرُونَ

‘ফেরাউন সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ (ফিরাউনকে) বলল, আপনি কি মূসা ও তার সম্প্রদায়কে মুক্ত ছেড়ে দেবেন, যাতে তারা (অবাধে) পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে এবং আপনাকে ও আপনার উপাস্যদের বর্জন করতে পারে? সে বলল, আমরা তাদের পুত্রদের হত্যা করব এবং তাদের নারীদেরকে জীবিত রাখব, আর তাদের ওপর আমাদের পরিপূর্ণ ক্ষমতা আছে।’ (আরাফ ৭ : ১২৭)।

قَالَ فِرْعَوْنُ آَمَنْتُمْ بِهِ قَبْلَ أَنْ آَذَنَ لَكُمْ إِنَّ هَذَا لَمَكْرٌ مَكَرْتُمُوهُ فِي الْمَدِينَةِ لِتُخْرِجُوا مِنْهَا أَهْلَهَا فَسَوْفَ تَعْلَمُونَ لَأُقَطِّعَنَّ أَيْدِيَكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ مِنْ خِلَافٍ ثُمَّ لَأُصَلِّبَنَّكُمْ أَجْمَعِينَ

‘ফেরাউন বলল, কী! আমি অনুমতি দেয়ার আগেই তোমরা এই ব্যক্তির প্রতি ঈমান আনলে? নিশ্চয় এটা কোনো চক্রান্ত। তোমরা এই শহরে পারস্পরিক যোগসাজশে এই চক্রান্ত করেছ, যাতে তোমরা এর বাসিন্দাদের এখান থেকে বহিষ্কার করতে পার। আচ্ছা, তোমরা শীঘ্রই এর পরিণাম জানতে পারবে। আমি তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব তারপর তোমাদের সবাইকে শূলে চড়াব।’ (আরাফ ৭ : ১২৩-১২৪)।

ক্ষমতার দাপটে ঔদ্ধত্যে বিভোর ফিরাউন :

فَقَالَ أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى فَأَخَذَهُ اللَّهُ نَكَالَ الْآَخِرَةِ وَالْأُولَى  إِنَّ فِي ذَلِكَ لَعِبْرَةً لِمَنْ يَخْشَى

‘সে বলল, আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক। পরিণামে আল্লাহ তাকে পাকড়াও করলেন আখেরাত ও দুনিয়ার শাস্তিতে। যে ভয় করে তার জন্য অবশ্যই এতে রয়েছে শিক্ষা।’ (নাযিয়াত ৭৯: ২৪-২৬)।

ঈমানদারের উপদেশ ও সতর্কবাণী :

وَقَالَ رَجُلٌ مُؤْمِنٌ مِنْ آَلِ فِرْعَوْنَ يَكْتُمْ إِيمَانَهُ أَتَقْتُلُونَ رَجُلًا أَنْ يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَبِّكُمْ وَإِنْ يَكُ كَاذِبًا فَعَلَيْهِ كَذِبُهُ وَإِنْ يَكُ صَادِقًا يُصِبْكُمْ بَعْضُ الَّذِي يَعِدُكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ مُسْرِفٌ كَذَّابٌ يَا قَوْمِ لَكُمُ الْمُلْكُ الْيَوْمَ ظَاهِرِينَ فِي الْأَرْضِ فَمَنْ يَنْصُرُنَا مِنْ بَأْسِ اللَّهِ إِنْ جَاءَنَا...

‘ফেরাউনের বংশের এক মুমিন ব্যক্তি, যে এ পর্যন্ত তার ঈমান গোপন রেখেছিল, বলে উঠল, তোমরা কি একজন লোককে কেবল এ কারণে হত্যা করবে যে, সে বলে আমার প্রতিপালক আল্লাহ? অথচ সে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে উজ্জ্বল নিদর্শন নিয়ে এসেছে। সে মিথ্যাবাদী হলে তার মিথ্যাবাদিতার জন্য সে দায়ী হবে। আর যদি সে সত্যবাদী হয়, তবে সে যে শাস্তি সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করছে, তার কিছু তো তোমাদের ওপর অবশ্যই আপতিত হবে। আল্লাহ কোনো সীমালঙ্ঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে হেদায়াত দান করেন না। হে আমার সম্প্রদায়! আজ তো রাজত্ব তোমাদের, জমিনে তোমরাই প্রবল। কিন্তু আমাদের ওপর যদি আল্লাহর আজাব এসে পড়ে, তবে এমন কে আছে, যে তাঁর বিপরীতে আমাদেরকে সাহায্য করবে?...।’ (মু’মিন ৪০ : ২৮-২৯)।

ঔদ্ধত্যের কারণে ফিরাউন ও কওমের পরিণতি :

وَاسْتَكْبَرَ هُوَ وَجُنُودُهُ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَظَنُّوا أَنَّهُمْ إِلَيْنَا لَا يُرْجَعُونَ فَأَخَذْنَاهُ وَجُنُودَهُ فَنَبَذْنَاهُمْ فِي الْيَمِّ فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الظَّالِمِينَ

‘ফেরাউন ও তার বাহিনী জমিনে অন্যায় অহমিকা প্রদর্শন করেছিল। তারা মনে করেছিল তাদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না। সুতরাং আমি তাকে ও তার সৈন্যদেরকে পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম। এবার দেখ, জালিমদের পরিণতি কী হয়ে থাকে! (সূরা : কাসাস ২৮ : ৩৯-৪০)।

وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ الْبَحْرَ فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ وَجُنُودُهُ بَغْيًا وَعَدْوًا حَتَّى إِذَا أَدْرَكَهُ الْغَرَقُ قَالَ آَمَنْتُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا الَّذِي آَمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ آَلْآَنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنْتَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ فَالْيَوْمَ نُنَجِّيكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُونَ لِمَنْ خَلْفَكَ آَيَةً وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ عَنْ آَيَاتِنَا لَغَافِلُونَ

‘আমি বনী ইসরাইলকে সাগর পার করিয়ে দিলাম। তখন ফিরাউন ও তার বাহিনী যুলুম ও সীমালঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। পরিশেষে যখন সে ডুবে মরার সম্মুখীন হলো, তখন বলতে লাগল, আমি স্বীকার করলাম, বনী ইসরাইল যেই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে তিনি ছাড়া কোনোও ইলাহ নেই এবং আমিও অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত। (উত্তর দেয়া হলো) এখন ঈমান আনছ? অথচ এর আগে তো তুমি অবাধ্যতা করেছ এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। সুতরাং আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তী কালের মানুষের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক। (কেননা) আমার নিদর্শন সম্পর্কে বহু লোক গাফেল হয়ে আছে।’ (ইউনুস ১০ : ৯০-৯২)।