• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

সরকারের নানামুখী উদ্যোগে বদলে যাচ্ছে অর্থনীতির চেহারা

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ৮ অক্টোবর ২০২০  

করোনার এই মহামারিকালেও গতিশীল হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা, শ্রমজীবী মানুষের পরিশ্রম ও সরকারের সহযোগিতা—এই তিন উদ্যোগ এক হওয়ায় অর্থনীতির চাকা স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও জোরে ঘুরছে। এক্ষেত্রে সাহস জোগাচ্ছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত রফতানি আয় এবং প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়।

রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় নিয়ে আশাবাদী পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে, এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতির অন্যান্য খাতও সচল হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে। তবে তার দৃষ্টিতে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে ঠিক রাখতে বড় শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখছে গরিব কৃষকদের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের পণ্য। কারণ, এখনও কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এখনও বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস কৃষি। কৃষকরা যদি খাদ্য উৎপাদন না করতো, তাহলে বড় বিপদ হতো।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত টানা তিন মাসে রেমিট্যান্সে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৬৭১ কোটি ৩১ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের  প্রথম তিন মাসে  যে পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে, তা গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের মোট রেমিট্যান্সের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একদিকে লাখ লাখ পরিবারের প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও মহামারির মধ্যে রেমিট্যান্স দিয়ে অনেকেই ছোট ছোট ব্যবসা শুরু করেছেন। এই টাকার একটি অংশ যাচ্ছে ব্যাংকে ও সঞ্চয়পত্রে। অনেকে শেয়ারবাজারেও বিনিয়োগ করছেন। অন্যদিকে রেমিট্যান্স দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

করোনাকালীন সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো এই রেমিট্যান্স প্রবাহ অর্থনীতির গতিকে আরও গতিশীল করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত। তিনি বলেন, ‘প্রবাসীদের এই অবদান সংকট মোকাবিলায় সাহস জোগাচ্ছে।’ একইসঙ্গে  রফতানি আয়ও সংকটকালীন সময়ে সাহস জোগাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি উল্লেখ করেন, উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা, শ্রমজীবী মানুষের পরিশ্রম ও সরকারের সহযোগিতা—এই তিন শক্তি এক হওয়ায় অর্থনীতির চাকা স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও জোরে জোরে ঘুরছে। এত অল্প দিনে সংকটে পড়া অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোকে বাঙালির ঐতিহ্যগত কারণ বলে মনে করেন তিনি। অগ্রণী ব্যাংকের এই চেয়ারম্যানের মতে, যে কোনও সংকট অনেক সময় সুযোগ তৈরি করে। যখন সবাই বিপদগ্রস্ত হয়, তখন সবাই একসঙ্গে বাঁচার চেষ্টা করে। একজনকে দেখে আরেকজন সাহস পায়, উৎসাহ পায়। আরেকজন আরেকজনকে সহযোগিতা করে। এতে একদিকে সংকট কেটে যায়, অন্যদিকে চাওয়ার চেয়েও পাওয়া হয়ে যায় বেশি। ‘কনজুমার কনফিডেন্ট’ বেড়ে যাওয়াতে অর্থনীতির চাকা এখন দ্রুত ঘুরছে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ার সুফল পাচ্ছে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের সুবিধাভোগীরাও। রেমিট্যান্স বাড়ার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি এখনও চাঙা রয়ে গেছে। এছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। ব্যাংকের আমানতও বাড়ছে। দীর্ঘদিনের মন্দায় থাকা পুঁজিবাজারে প্রাণ ফিরে আসতে শুরু করেছে। গলির দোকান থেকে শুরু করে বড় শিল্পকারখানা—সবই চলছে স্বাভাবিক সময়ের মতো। আমদানি-রফতানি, উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও পরিবহন চলাচল অনেকটাই স্বাভাবিক হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর মাসে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। এর আগে গত জুলাই মাসে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিল প্রবাসীরা, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে এ বছরের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৪৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। বিভিন্ন দেশ থেকে এক কোটির বেশি বাংলাদেশির পাঠানো এই রেমিট্যান্সের অবদান জিডিপিতে ১২ শতাংশের মতো।

এদিকে করোনার মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ প্রায় ১০ বিলিয়ন (এক হাজার কোটি) ডলার আয় করেছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে আরও বেশি—২ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে ৩৯১ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল। সেপ্টেম্বরে এর পরিমাণ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। তিন মাসে মোট ৯৮৯ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রফতানি হয়েছে।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৯৮৯ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৬৬ কোটি ডলার। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে রফতানি হয়েছে ৩০১ কোটি ডলারের পণ্য। এই আয় গত বছরের একই সময় হয়েছিল ২৯১ কোটি ডলার। অর্থাৎ স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও করোনাকালে ৩.৫৩ শতাংশ বেশি রফতানি আয় হয়েছে।

এর মধ্যে গত তিন মাসে মোট তৈরি পোশাক পণ্য রফতানি হয়েছে ৮১২ কোটি ৬৩ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২.৯ শতাংশ বেশি। আর গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ০.৮৫ শতাংশ বেশি।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘করোনার কারণে স্থগিত হওয়া পণ্যগুলো এখন রফতানি হচ্ছে। একইসঙ্গে নতুন পণ্যও রফতানি হচ্ছে। এর ফলে এ সময় রফতানি কম হওয়ার মৌসুম হলেও রফতানি বাড়ছে।’ রফতানি আয় এভাবে বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতির অন্যান্য খাতও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ৭ হাজার ৪৫৫ কোটি ৫ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই অঙ্ক গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের দ্বিগুণেরও বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ৩ হাজার ৭১২ কোটি ৩৬ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। এছাড়া ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি। গত আগস্ট মাস শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ১ হাজার ৬৭৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা গত বছরের আগস্টের চেয়ে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ।

এদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। আর এ কারণেই চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৬ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়তে পারে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যও বলছে, চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরের শুরুতে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে প্রবৃদ্ধি। সর্বশেষ গত আগস্টে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি গত দুই বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের (২০১৯ সালের ) আগস্টে রাজস্ব আয়ের কোনও প্রবৃদ্ধিই ছিল না। উল্টো আগের বছরের (২০১৮ সালের) তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছিল ৫ শতাংশ। আর ২০১৮ সালের আগস্টে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

এনবিআরের হিসাবে, গত আগস্ট মাসে ১৫ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে এনবিআর। যা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেকোনও আগস্ট মাসের চেয়ে বেশি। গত বছরের আগস্টে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১৪ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের আগস্টে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১৪ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। আর  ২০১৭ সালের আগস্টে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১৪ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের আগস্টে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১২ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা।

প্রসঙ্গত, করোনাকালে দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন খাতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার।