• সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

  • || ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর পেনশন চালুর চিন্তা

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ৩০ মার্চ ২০২৪  

সরকারি চাকরিজীবীদের মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীর জন্য পেনশন চালুর চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এটি চালু হলে অবসরের পর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা এককালীন টাকার পাশাপাশি প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পাবেন। বর্তমানে দেশে ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত। তারা প্রতি মাসে সরকার থেকে মূল বেতন ও নির্দিষ্ট অঙ্কের বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা পান।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্রে জানা গেছে, পেনশন চালুর সিদ্ধান্ত হলে ‘বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী পেনশন বোর্ড’ গঠন করা হবে। বর্তমানে চালু থাকা ‘বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড’ ও ‘বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট’ বিলুপ্ত হবে।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে বেসরকারি শিক্ষকদের কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডের আর্থিক বিষয়ে আলোচনা করতে একটি সভা হয়। শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ছাড়াও শিক্ষা প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সভায় অংশ নেন। এ সভায়ই বেসরকারি শিক্ষকদের পেনশন চালুর প্রস্তাব করা হয়। সভায় অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, সরকারের সর্বজনীন পেনশনের মতোই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদেরও পেনশন চালুর বিষয়ে সভায় প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকরা চাকরিজীবন শেষে অবসরের পুরো টাকা একসঙ্গে পাবেন না। অবসরের অর্ধেক টাকা এককালীন পরিশোধ করা হবে। বাকি অর্ধেক টাকা তাদের পেনশন আকারে দেওয়া হবে। পেনশনের টাকা শিক্ষকরা আজীবন পাবেন। কোনো শিক্ষক মারা গেলে তাঁর মনোনীত ব্যক্তিকে (নমিনি) পেনশনের টাকা দেওয়া হবে।

সভায় অংশ নেওয়া বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু বলেন, পেনশন চালু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। কারণ, সভাটি অনানুষ্ঠানিক ছিল। তবে এটা চালু করা নিয়ে শিক্ষক সংগঠনগুলো বহু আগে থেকেই আলোচনা ও প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে।

সভায় অংশ নেওয়া বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ শরীফ মোহাম্মদ সাদী বলেন, সর্বজনীন পেনশন যেহেতু চালু হয়েছে, সেই একই পদ্ধতিতে বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদেরও পেনশন চালু করা যায়। এটি বাস্তবায়ন করতে হলে অবসর বোর্ডের আইন পরিবর্তন করতে হবে। সে জন্য সভায় উচ্চ পর্যায়ের একটি কারিগরি কমিটি গঠনের প্রস্তাব উঠেছে।

এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা ১৯৯০ সাল থেকে কল্যাণ ট্রাস্টের সুবিধা পাচ্ছেন। ২০০৫ সালে শুরু হয়েছে অবসর সুবিধা দেওয়া। এ দুই সুবিধা বাবদ তারা এককালীন অর্থ পেয়ে থাকেন। এ জন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের এমপিও অংশ থেকে চাঁদা হিসাবে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ কেটে রাখা হয়।

তবে অর্থ সংকটের কারণে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট বর্তমানে ধুঁকছে। যে কারণে অবসরের পর টাকা পেতে দুই থেকে তিন বছর লেগে যাচ্ছে।

রাজধানীর পলাশীর ব্যানবেইস ভবনে অবসর সুবিধা বোর্ডের কার্যালয়ে গিয়ে জানা গেছে, তিন বছর আগের অবসর সুবিধার আবেদন বর্তমানে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের টাকা এখন দেওয়া হচ্ছে। অবসর বোর্ডে জমে আছে ৩৫ হাজার ৭২০টি আবেদন।

জানা গেছে, সরকার থেকে এ বোর্ডকে সিড মানি হিসেবে কয়েক দফায় মোট ৮২৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এ টাকার সুদ বাবদ মাসে সাড়ে ৩ কোটি টাকা বোর্ডের আয় হয়। আর প্রতি মাসে ৫ লাখ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন থেকে দেওয়া ৬ শতাংশ চাঁদা বাবদ আয় হয় ৭৩ কোটি টাকা। সুদ ও চাঁদার টাকা মিলিয়ে সাড়ে ৭৬ কোটি টাকা আয় হয়। অবসর বোর্ডে প্রতিদিন গড়ে ৩০টি আবেদন জমা পড়ে। মাসে ৯০০ থেকে ১ হাজার আবেদন আসে।

বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী জানান, একটি আবেদন নিষ্পত্তি করতে গড়ে ১২ লাখ টাকা লাগে। সেই হিসাবে প্রতি মাসে ৯০০ আবেদন নিষ্পত্তি করতে বোর্ডের টাকা দরকার ১০৮ কোটি। ৩২ কোটি টাকা প্রতি মাসে ঘাটতি থাকে।

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পেতে দিনের পর দিন অবসরের পর ঘুরতে হচ্ছে শিক্ষক-কর্মচারীদের। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের আবেদন বর্তমানে নিষ্পত্তি করছে এই ট্রাস্ট। এই মুহূর্তে ২৬ হাজার ২২০টি আবেদন জমা আছে। ট্রাস্টের সচিব অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু জানান, প্রতি মাসে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের দেওয়া ৪ শতাংশ চাঁদা ও ডিপোজিট থেকে তাদের আয় ৫২ কোটি টাকার মতো। প্রতি মাসে প্রায় ৮০০ আবেদন জমা পড়ে। যে পরিমাণ আবেদন জমা পড়ে, তা নিষ্পত্তি করতে গেলে লাগে ৬২ কোটি টাকার বেশি। ঘাটতি থাকে ১০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে প্রতিবছর জুলাইয়ে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেওয়ায় ঘাটতি আরও বেড়ে যাচ্ছে।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫ লাখের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারীকে ছয় মাসের মধ্যে অবসর সুবিধা (রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট) দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, শিক্ষকদের অবসর সুবিধা পেতে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। এই হয়রানি থেকে তারা কোনোভাবেই পার পান না। একজন প্রাথমিকের শিক্ষক কত টাকা বেতন পান, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। অবসর ভাতা পাওয়ার জন্য শিক্ষকরা বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে পারেন না।

আইনজীবীরা জানান, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট প্রবিধানমালা, ১৯৯৯ এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড প্রবিধানমালা, ২০০৫ অনুযায়ী শিক্ষক ও কর্মচারীদের মূল বেতনের ২ শতাংশ এবং ৪ শতাংশ কাটার বিধান ছিল। এর বিপরীতে ট্রাস্টের তহবিল থেকে শিক্ষক ও কর্মচারীদের কিছু আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হতো। তবে ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল শিক্ষক ও কর্মচারীদের মূল বেতনের ২ শতাংশ এবং ৪ শতাংশ কাটার বিধানগুলো সংশোধন করে ৪ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ করে দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত অর্থ কাটার বিপরীতে শিক্ষক ও কর্মচারীদের কোনো বাড়তি আর্থিক সুবিধার বিধান করা হয়নি।

২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এক প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষক ও কর্মচারীদের এপ্রিল মাসের বেতন থেকে ৬ শতাংশ এবং ৪ শতাংশ টাকা অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টে জমা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়। কোনো আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি না করেই মূল বেতনের ৬ শতাংশ এবং ৪ শতাংশ টাকা কাটার আদেশ বাতিল করার জন্য শিক্ষক ও কর্মচারীরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ দাবিতে তারা বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধনসহ কর্মসূচি পালন করেন। এক পর্যায়ে তারা প্রজ্ঞাপনটি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন। শুনানি শেষে আদালত ছয় মাসের মধ্যে অবসর সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দেন।