• সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

  • || ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে আব্বাকে খুঁজতো রাসেল

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ১৮ অক্টোবর ২০২২  

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফ দাবি দেওয়ার পর যখন গ্রেফতার হয়েছিলেন শেখ রাসেল তখন কেবল কথা বলতে শুরু করেছিল। বঙ্গবন্ধু কারাগারে যাওয়ার পর সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে বাবাকে খুঁজতো শেখ রাসেল। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ে স্মৃতিচারণ করে এসব কথা লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গ্রন্থে শেখ হাসিনা রাসেলের জন্ম থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন তার নাম রাখার বিষয়টি নিয়েও। তিনি লিখেছেন, জন্মের সময় রাসেলের মাথাভরা ঘন কালোচুল ছিল। ৬ দফা দেওয়ায় পিতা মুজিব গ্রেফতার হওয়ার পর রাসেলের মুখে হাসি মুছে গিয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর রাসেলের জন্ম হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসায়, আমার শোয়ার ঘরে। দোতলা তখনও শেষ হয়নি। বলতে গেলে মা একখানা করে ঘর তৈরি করেছেন। একটু একটু করেই বাড়ির কাজ চলছে। নিচতলায় আমরা থাকি। উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরটা আমার ও কামালের। সেই ঘরেই রাসেল জন্ম নিলো রাত দেড়টায়... রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখবো, ফুফু বললেন তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিলো রাসেল।’

রাসেলের নামকরণের বিষয়টিও উঠে এসেছে শেখ হাসিনার লেখায়। নামকরণটা স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। সেই প্রিয় লেখকের নামের সঙ্গে মিল রেখে আদরের সন্তানের নাম রাখেন শেখ রাসেল। শিশু রাসেলের বেশি সময় কেটেছে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে। বাবাকে না পেয়ে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে আব্বা বলে সম্বোধন করতো রাসেল। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বন্দি হয়ে প্রায় সময় কারাগারে থাকতেন। তাছাড়া দেশ ও রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ততার কারণে বাবার বেশি সান্নিধ্য পায়নি রাসেল। স্কুলের রাজনৈতিক জীবন থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত নানা পর্বে, নানা ঐতিহাসিক ঘটনায় বঙ্গবন্ধু কারাগারের চার দেয়ালে বন্দি ছিলেন দীর্ঘ সময়। তাই বলা হয়ে থাকে, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ছিল তিনটি। একটি টুঙ্গিপাড়ায়, আরেকটি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে, আর তৃতীয় বাড়িটি ছিল অবরুদ্ধ কারাগার।

শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আব্বা যখন ৬-দফা দিলেন তারপরই তিনি গ্রেফতার হয়ে গেলেন। রাসেলের মুখে হাসিও মুছে গেল। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে রাসেল আব্বাকে খুঁজতো। রাসেল যখন কেবল হাঁটতে শিখেছে, আধো আধো কথা বলতে শিখেছে, আব্বা তখনই বন্দি হয়ে গেলেন। মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আব্বার মামলা-মোকদ্দমা সামলাতে, পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। সংগঠনকে সক্রিয় রেখে আন্দোলন-সংগ্রাম চালাতেও সময় দিতে হতো।’

এদিকে শেখ রাসেলের ৫৯তম জন্মদিন উপলক্ষে বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাসেল নামটি শুনলেই প্রথমে যে ছবিটি সামনে আসে তা হলো- হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণচঞ্চল এক ছোট্ট শিশুর দুরন্ত; যে শিশুর চোখগুলো হাসি-আনন্দে ভরপুর। মাথা ভর্তি অগোছালো চুলের সুন্দর একটি মুখাবয়ব- যে মুখাবয়ব ভালোবাসা ও মায়ায় মাখা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ইতিহাসের এক নির্মম, জঘন্য ও বিভীষিকাময় রাতের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, এখনও ভাবি, কারও বিরুদ্ধে শত্রুতা থাকতেই পারে, কিন্তু সেই ক্ষোভ একজন কোমলমতি শিশুকে কেন কেড়ে নেবে? এই শিশু কী দোষ করেছিল। সে তো কোনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। সে কেন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অংশ হবে? এতসব স্মৃতি স্মরণ করতে কষ্ট হয়। চোখ ভিজে ওঠে, বুকে পাথর বেঁধে সেইসব স্মৃতির সাগরে ডুব দেই। কারণ সেদিন ঘাতকের বুলেট যে কোমলমতি শিশুটির প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, সে ছিল নির্দোষ-নিষ্পাপ। মহানুভবতা ও ব্যবহারে সে ছিল অমায়িক। রাসেল যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে হয়তো মহানুভব, দূরদর্শী ও আদর্শ নেতা আজ আমরা পেতাম, যাকে নিয়ে দেশ ও জাতি গর্ব করতে পারতো।

শেখ হাসিনার লেখা স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়- ৪ বছর বয়সে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে শেখ রাসেলের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। প্রথম দিকে পরিবারের কাউকে না কাউকে স্কুলে দিয়ে আসতে হতো। ধীরে ধীরে নিজেই স্কুলের ব্যাপারে আগ্রহী হয় শেখ রাসেল। তখন স্কুলের যাওয়ার জন্য রাসেল ব্যাকুল হতো। স্কুলের মধ্যেই রাসেলের অনেক বন্ধু জুটে যায়। মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার। সে বন্ধুবৎসল ছিল। ধীরে ধীরে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে ওঠে রাসেল। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে শেখ রাসেলের জন্য একজন গৃহশিক্ষিকা রাখা হয়।

শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণে জানা যায়, শিক্ষিকাকে খুব সম্মান করতো শেখ রাসেল। খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিল তাই শিক্ষককে রাসেলের কথা শুনতে হতো। নইলে সে পড়াশোনায় মনোযোগী হতো না। তাই শিক্ষিকাও রাসেলের কথা অনুযায়ী শিক্ষাদান করতেন। শিক্ষিকার খাবার-দাবারের ব্যাপারে খুব সচেতন ছিল শেখ রাসেল। প্রত্যেক দিন শিক্ষিকার জন্য দুটি করে মিষ্টি বরাদ্দ থাকতো এবং শিক্ষিকাকে খেতে হতো রাসেলের ইচ্ছানুযায়ী। এভাবেই চলছিল শেখ রাসেলের বাল্যকাল। তখন পরিবারের সবার আদর কেড়ে হই হুল্লোড়ে মাতিয়ে রাখতো ৩২ নম্বর ধানমন্ডির পুরো বাড়ি। ঐতিহাসিক এই বাড়িতে দিনভর রাজনৈতিক নেতাদের আনাগোনা, সভায় মুখরিত থাকতো। সেখানেও সবার স্নেহ কাড়তো ফুলের মতো শিশু রাসেল। ছোট্ট একটি বাই-সাইকেল নিয়ে ছুটে বেড়াতো বাড়ির আঙিনায়। আর ৩২ নম্বরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন স্নেহময়ী মা তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন দুষ্টু ছেলেটির সাইকেল-পরিক্রমা যেন তার চোখের পলকেই থাকে।