• মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৭ ১৪৩১

  • || ১২ জ্বিলকদ ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ
ব্রেকিং:
ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক সকল ক্ষেত্রে সঠিক পরিমাপ নিশ্চিত করার আহ্বান রাষ্ট্রপতির ওজন ও পরিমাপ নিশ্চিতে কাজ করছে বিএসটিআই: প্রধানমন্ত্রী চাকরির পেছনে না ছুটে যুবকদের উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান ‘সামান্য কেমিক্যালের পয়সা বাঁচাতে দেশের সর্বনাশ করবেন না’ যত ষড়যন্ত্র হোক, আ.লীগ সংবিধানের বাইরে যাবে না: ওবায়দুল কাদের শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আগামীকাল ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচারকদের প্রতি আহ্বান রাষ্ট্রপতির আহতদের চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা চান প্রধানমন্ত্রী

বিদেশি বন্ধুর উপহারের ফাঁদ, কাস্টমসের নামে প্রতারণা

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ৩ মার্চ ২০২০  

প্রতারণার কৌশলটি মোটামুটি পুরনো। তবুও সচেতনতার অভাবে লোভে পড়ে অনেকেই খোয়াচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। প্রতারণার এ চক্রে জড়িত দেশি-বিদেশি নাগরিকরা। ইংল্যান্ড-আমেরিকার নাগরিক পরিচয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে চলা বন্ধুত্বের একপর্যায়ে বিদেশি বন্ধুটি দামি উপহার পাঠান বাংলাদেশি বন্ধুকে। ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায় সেই উপহারের পার্সেল। বিমানবন্দরের কাস্টমসে শুল্ক বাবদ টাকা পরিশোধ করলেই উপহারগুলো কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পৌঁছে যাবে বাড়িতে। কিন্তু টাকা পরিশোধ করার পরও উপহার বাড়িতে যায় না। বরং কাস্টমসের নামে নানা কৌশলে চাওয়া হয় শুল্ক ও ঘুষ বাবদ টাকা। এত কিছুর পরও বিদেশি বন্ধুর উপহার পান না বাংলাদেশি বন্ধু। কেউ কেউ বিশ্বাস করতে চান না তিনি প্রতারিত হয়েছেন। বরং আক্ষেপ করতে থাকেন—এতটাই খারাপ ঢাকা বিমানবন্দর আর কাস্টমস কর্মকর্তারা!

 

বিমানবন্দর ও কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে কমপক্ষে শতাধিক মানুষ এ প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন। দামি উপহারের লোভে পড়ে অনেকেই কাস্টমসের নামে চাওয়া ‘শুল্ক ও ঘুষ’ বাবদ লাখ লাখ টাকা খরচ করলেও কোথাও কোনও অভিযোগ দেননি। বরং উল্টো উপহারের আশায় থেকে দুষেছেন বিমানবন্দর ও কাস্টমসকে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা কাস্টমস হাউসের সহকারী কমিশনার সোলাইমান হোসেন বলেন, ‘যখন কাস্টমসের নামে ঘুষের টাকা চাওয়া হয়, তখন কেউ অভিযোগ দিতে আসেন না। লাখ লাখ টাকা প্রতারকচক্রের হাতে তুলে দেওয়ার পরও অনেকে জানতে আসেন, কাস্টমস কেন বিদেশ থেকে আসা তার উপহার দিচ্ছে না।’

সহকারী কমিশনার সোলাইমান হোসেন বলেন, ‘অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। কাস্টমস কোনোভাবেই শুল্ক হোক কিংবা অন্য কোনও চার্জ হোক, কারও কাছে টেলিফোন করে টাকা চাইবে না। কারও মালামাল আসলে সেটাও কাস্টমস থেকে কাউকে জানানো হয় না। কারণ, কার মালামাল আসলো, কবে আসলো, সেটি দেখার দায়িত্ব কাস্টমসের নয়। কাস্টমস শুধু দেশে আসা মালামালের বিপরীতে সঠিকভাবে শুল্ক আদায় করে থাকে। কেউ যেন শুল্ক ফাঁকি দিতে না পারে, কিংবা আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য আনতে না পারে, সেটি নজরদারি করে।’

তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, যারা প্রতারিত হচ্ছেন তারা কেউই একেবারে অশিক্ষিত নন। কারণ, প্রতারকচক্র বিদেশি, তাদের সঙ্গে ইংরেজিতেই যোগাযোগ হয়। আবার অনেকে বিশ্বাস করতে চান না, তিনি প্রতারিত হয়েছেন। যেহেতু তার বন্ধুটি বিদেশি, তাই সে প্রতারক হতে পারে না। প্রাপক সবকিছুর দায় কাস্টমসের ওপর দিতে চান।’

ডলারের এই ছবি পাঠিয়ে বলা হয় এগুলো পার্সেল করা হয়েছেসিরাজগঞ্জে থাকেন রুপালি আক্তার। ইনস্টাগ্রামে ডেভিট নামে ইংল্যান্ডের এক নাগরিকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ডেভিটই তার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করেন। প্রায় এক বছর ধরে চলা এই বন্ধুত্বের একপর্যায়ে ডেভিট রুপালিকে উপহার পাঠানোর কথা বলেন। ডেভিট কী ধরনের উপহার পাঠানোর কথা বলেছেন,এ প্রশ্নের উত্তরে রুপালি বলেন, ‘মোবাইল, পাউন্ড, সোনার গয়না, কসমেটিকস।’

রুপালি বলেন,‘গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ডেভিট আমার নামে এসব উপহার পার্সেল করে। ১৭ ফেব্রুয়ারি সে জানায়, তার পাঠানো পার্সেল ঢাকা এয়ারপোর্টে চলে এসেছে। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পার্সেল আমার বাড়িতে চলে যাবে। তখন আমি চিকিৎসার জন্য ভারতে ছিলাম। এক লোক আমাদের ফোন দেয়, সেও বিদেশি। সে জানায়—আমার জন্য পাঠানো উপহারগুলোর কাস্টমস ফি বাবদ ৬০০ ডলার খরচ করতে হবে, যা বাংলাদেশি টাকায় ৫০ হাজার ৪০০ টাকা। আমি তখন ভারতে ছিলাম, তাই আমার মাকে বলি তাদের নামে সেই টাকা পাঠাতে। একদিন পর সেই বিদেশি আবারও ফোন দেয়— আমার মালামাল রেডি। আজকেই আমার বাড়িতে তারা পার্সেল পৌঁছে দেবে। ঘণ্টাখানেক পর আবারও ফোন দিয়ে বলে কাস্টমসের যিনি সাইন করবেন তিনি আসেননি। আর আমার নামে আসা পার্সেলে থাকা মোবাইল, টাকা, অলঙ্কার স্ক্যান করে ধরা পড়েছে। এ কারণে আরও চার লাখ টাকা শুল্ক দিতে হবে।

তখনই সন্দেহ হওয়ায় শাহজালাল বিমানবন্দরে চলে আসেন রুপালি, সব খুলে বলেন বিমানবন্দরে কর্তব্যরত আর্মড পুলিশের কাছে। রুপালির সহায়তায় নাইজেরিয়ার নাগরিক জশুয়া চুকউজিয়োক ডেভিট (৩২) নামে এক ব্যক্তিকে ২০ ফেব্রুয়ারি আটক করে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। আটক ওই ব্যক্তিই টেলিফোনে কাস্টমস ফি’র টাকা চেয়ে ফোন করেছিলেন রুপালিকে।

কাস্টমস ও পুলিশ জানিয়েছে, প্রতারকচক্র বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের টার্গেট করে। প্রায় সব নারীর ক্ষেত্রেই কাস্টমস থেকে দামি উপহার ছাড়িয়ে নেওয়ার ফাঁদে ফেলে টাকা নেওয়া হয়। তবে পুরুষরাও এ চক্রের খপ্পরে পড়েছেন। যদিও পুরুষকে ফাঁদে ফেলার গল্পটা একটু ভিন্ন।

পুরুষদের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নারী সেনা সদস্য পরিচয়ে যোগাযোগ করা হয়। সেই নারী সেনা সদস্য জানান, তার পরিবারে আর কেউ নেই। সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে আছেন সেই নারী সেনা। বেতনভাতাসহ উপার্জনের কোটি ডলার আছে তার কাছে। কিন্তু সেই নারী সেনা আর যুদ্ধ করতে চান না, ফিরেও যেতে চান না আমেরিকায়। বিশ্বস্ত কাউকে পেলে তিনি ব্যবসা করবেন বাংলাদেশে, অন্যথায় চলে যাবেন অন্য কোনও দেশে। অনেককে আবার সংসার পাতার গল্পও বলা হয়। আপৎকালীন সময়ে তার কোটি ডলার রাখতে চান বাংলাদেশি বন্ধুর কাছে, বিনিময়ে তাকেও মোটা অঙ্কের টাকার ভাগ দেবেন, করবেন ব্যবসার পার্টনার।

এমন প্রতারণার ফাঁদে পড়েছিলেন আমিন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, ‘এমন খপ্পরে পড়ে আমি গত নভেম্বরে এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা হারিয়েছি। আমাকে বলেছে, সে আমেরিকার মেরিন আর্মি সার্জেন্ট অফিসার, তার মা-বাবা, ভাইবোন কেউ নেই। এক্সিডেন্টে মারা গেছেন তারা। সব সময় তার মৃত মা-বাবার কসম করতো। তার এক চাচার কাছে সে বড় হয়েছে। চাচা তাকে খুব নির্যাতন করতো। আমাকে জীবনসঙ্গী করে সে আমেরিকা নিয়ে যাবে, প্রয়োজনে সে আমাকে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করবে। কিন্তু এসবই ছিল তার প্রতারণা। সে বিভিন্ন রকম কৌশল করে আমার সব টাকা নিয়ে আমাকে ভিখারি করেছে। আমি সুদে টাকা ধার নিয়ে খরচ করেছিলাম। সেই সুদের টাকার জন্য আজ আমি পলাতক।’

এমন অভিজ্ঞতা শুধু এক-দুজনেরই নয়। গত কয়েকবছরে এ ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন অনেক মানুষ। কেউ দুই লাখ, কেউ পাঁচ লাখ, আবার কেউবা আরও বেশি টাকা খুইয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়, তারপর কথোপকথন, উপহার, বিদেশ নিয়ে যাওয়া, মূল্যবান উপহার পাঠানোসহ নানা কৌশলে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে বিদেশে চাকরি দেওয়ার নাম করেও প্রতারণা করা হয়।

বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপারেশন্স অ্যান্ড মিডিয়া) আলমগীর হোসেন বলেন, ‘একটি প্রতারকচক্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণা করে আসছে। তারা যুক্তরাজ্যের নাগরিক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়। দীর্ঘ সময় আলাপের পর নারীদের কাছে দামি উপহার পাঠানোর কথা বলে। কাস্টমস থেকে উপহার ছাড়ানোর নামে টার্গেট ব্যক্তিকে টাকা পাঠাতে বলে। এভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল চক্রটি। সম্প্রতি আমরা এমন একটি চক্রের সদস্যকে আটক করেছি।’

আলমগীর হোসেন বলেন, ‘সমাজের প্রতিষ্ঠিত অনেকেই এই প্রতারকচক্রের ফাঁদে পড়েছেন। কোনও উপহারের লোভে না পড়ে, সর্তক থাকা প্রয়োজন।’