• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

চীনে জোরপূর্বক ‘শয্যাসঙ্গী’ করা হচ্ছে মুসলিম উইগুর নারীদের

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ৬ নভেম্বর ২০১৯  

 


চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে ‘সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের’ নামে বিভিন্ন ক্যাম্পে ১০ লাখের মতো সংখ্যালঘু মুসলিম উইগুরকে আটকে রেখেছে দেশটির কম্যুনিস্ট সরকার। বন্দিদের বেশিরভাগই পুরুষ। নজরদারির নামে এসব বন্দির পরিবারে থাকা নারী সদস্যদের নিয়মিত চীনা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘শয্যাসঙ্গী’ হতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। 

বুধবার (৬ নভেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সংবাদ সংস্থা রেডিও ফ্রি এশিয়া’র (আরএফএ) বরাত দিয়ে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেন্ডেন্টের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। 

খবরে বলা হয়, সরকারি নির্দেশে ক্যাম্পে বন্দি উইগুরদের পরিবারগুলোতে নিয়মিত নজরদারিমূলক পরিদর্শন চালায় নিয়োগপ্রাপ্ত চরেরা। এসব পরিদর্শনের সময়সীমা সর্ব্বোচ্চ এক সপ্তাহ। সে সময় তারা ওইসব পরিবারের নারীদের সঙ্গে একই বিছানায় রাত্রিযাপন করে। 

এটিকে মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তাদের মতে এটি সরাসরি মানুষের মৌলিক অধিকারের অমর্যাদা। 

ইন্ডিপেন্ডেন্ট বলছে, নিয়মিত ভিত্তিতে চালানো নজরদারিমূলক এসব পরিদর্শন চীনে মুসলিম উইঘুরদের ওপর চালানো পদ্ধতিগত দমননীতির অংশ। 

খবরে বলা হয়, সরকারি নির্দেশে গত বছরের প্রথমদিক থেকেই বাড়িতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রবেশাধিকার দিতে বাধ্য হয় উইগুর পরিবারগুলো। নজরদারিমূলক এসব পরিদর্শনকালে সরকার পক্ষের লোকজনকে নিজেদের জীবনযাপন বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে জানাতে বাধ্য হয় তারা। শুধু তাই নয়, চীনা কর্মকর্তারা এসময় পরিবারগুলোকে ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট পার্টির আদর্শ দীক্ষা দিয়ে থাকে। উইগুরদের মান্দারিন ভাষা ও কম্যুনিস্ট পার্টির গান শেখানো, দলীয় কাজে অংশ নেওয়া ও ঘরের কাজে সাহায্য করার জন্য এ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে বলে চীনের দাবি। 

চীনে জোরপূর্বক মুসলিম উইঘুর নারীদের ‘শয্যাসঙ্গী’ করা হচ্ছে

এ প্রকল্পের আওতায় দেশটি ১০ লাখেরও বেশি চর মোতায়েন করেছে। এদের বেশিরভাগই স্থানীয় হান সম্প্রদায়ের লোক। প্রত্যেক ২ মাস পরপর তাদের নির্দিষ্ট উইগুর পরিবারে গিয়ে সর্ব্বোচ্চ এক সপ্তাহ পর্যন্ত অবস্থান করতে হয়। একে ‘জুটি বাঁধা ও এক পরিবার হয়ে ওঠা’ প্রকল্প বলে উল্লেখ করছে চীন। এসব চরকে উইগুর পরিবারগুলোর ‘আত্মীয়’ বলে অভিহিত করছে তারা। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইয়েঙ্গিসার কাউন্টির ৭০ থেকে ৮০টি উইগুর পরিবারের তত্ত্বাবধানকারী কম্যুনিস্ট পার্টির এক কর্মকর্তা জানান, বাড়ি পরিদর্শনকালে তথাকথিত ওইসব আত্মীয়রা উইগুর পরিবারগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন কাজকর্ম, থাকা, খাওয়া, ঘুমসহ সব ধরনের প্রাত্যহিক কাজ করে থাকে। এর মধ্য দিয়ে অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে মেলামেশার ফলে বিদেশি মুসলিম সংস্কৃতির বদলে উইগুররা চীনের মূল সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আত্তীকরণ করতে পারবে বলে চীন সরকারের দাবি।  

ওই কর্মকর্তা জানান, ‘পরিদর্শকরা রাত-দিন তাদের জন্য নির্ধারিত পরিবারগুলোর সঙ্গে কাটায়। সাধারণত এক বিছানায় এক থেকে দুইজন ঘুমায়। কিন্তু আবহাওয়া ঠাণ্ডা থাকলে একসঙ্গে ৩ জনও ঘুমায়।’  

তিনি দাবি করেন, এক সঙ্গে রাত্রিযাপনের সময় নারীদের যৌন হেনস্থা করার কোনো ঘটনার কথা এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। ওইসব পুরুষ আত্মীয়দের সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমানো এখন নারীদের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। 

এ কর্মকর্তা আরও বলেন, চরেরা মূলত উইগুর পরিবারগুলোকে তাদের মতাদর্শ, নতুন দৃষ্টিভঙ্গী ‘উপহার দেওয়ার’ কাজ করে। এসময় তারা পরিবারগুলোর সঙ্গে ‘জীবনবোধ’ নিয়েও কথা বলে। এতে করে পারস্পরিক অনুভূতি ও আত্মীয়তা তৈরি হয়।   

সরকারের পক্ষ থেকে বাড়িতে চরদের অতিথি করার বিষয়টিকে ‘ঐচ্ছিক’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু, উইগুররা জানে রাষ্ট্রীয় কোনো পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করলে তাদের কপালে কোন পরিণতি অপেক্ষা করছে। তাদের সম্ভাব্য চরমপন্থী বলে ছিল মারা হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, তথাকথিত এসব ‘আত্মীয়’রা বর্তমানে উইগুরদের একান্ত নিজস্ব জীবনাচার- বিয়ে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির।

এ প্রকল্পের ব্যাপারে ইয়েঙ্গিসার’র কমিটি প্রধান জানান, পরিদর্শনকালে নিয়মিতই পুরুষ কর্মকর্তারা উইগুর নারীদের সঙ্গে ঘুমান। ঘুমের সময় নারীদের সঙ্গে তাদের ১ মিটার দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া আছে। একই বিছানায় ঘুমানোর ব্যাপারে এখন পর্যন্ত তিনি কারো অভিযোগ পাননি।

চীনে জোরপূর্বক মুসলিম উইঘুর নারীদের ‘শয্যাসঙ্গী’ করা হচ্ছে  

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ জানায়, চরদের পরিদর্শন প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যানের কোনো সুযোগ উইগুর পরিবারগুলোর নেই। কিন্তু অন্য মানুষের সঙ্গে জোরপূর্বক মেলামেশার এ ধরনের চর্চা ভয়ানক আগ্রাসন। এটি কেবল মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন নয়, এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে অসন্তোষ ক্রমে আরও বাড়বে। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের চীনা কর্মকর্তা মায়া ওয়াং বলেন, উইগুর মুসলিমরা আক্ষরিক অর্থেই এখন নিজের ঘরেও রাষ্ট্রের প্রহরী চোখের নিচে খাচ্ছে ও ঘুমাচ্ছে। 

নির্বাসিত উইগুরদের গঠিত সংগঠন ‘বিশ্ব উইঘুর কংগ্রেস’র মুখপাত্র পিটার ইরউইন বলেন, এটি চীনে মুসলিম নিপীড়নের এক বিকৃত পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়ে ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক জীবনের সীমানা নস্যাৎ কর দেওয়া হয়েছে। এটি উইগুরদের আত্মপরিচয় মুছে ফেলার প্রকল্প, যাতে মানুষ নিজেদের কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। 

‘বিশ্বের আর যে কোনোখানে, যে কোনো দেশে এ ধরনের কোনো কিছুকে মস্তিষ্কবিকৃতি হিসেবে দেখা হবে। কিন্তু চীনে এটি তাদের প্রকল্পের এক স্বাভাবিক অংশ, যা তারা গত দুই-তিন বছর ধরেই চালাচ্ছে। মানুষকে নজরদারিতে রাখা তবুও একটা কিছু। কিন্তু একই বিছানায় ঘুমানোর মতো এমন বিকৃত ব্যাপার আমরা আগে দেখিনি।’   

২০১৪ সালে জিননিয়ান অঞ্চলে বেশ কিছু হামলা চালানোর অভিযোগে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে উইগুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিশাল অভিযান শুরু করে চীন। পরবর্তীতে তারা প্রায় দশ লাখ উইগুরকে ক্যাম্পে বন্দি করে। শুরুতে এসব ক্যাম্পের কথা অস্বীকার করলেও, পরবর্তীতে চীন এগুলোকে ঐচ্ছিক সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বলে দাবি করে।  

কিন্তু নারীসহ ক্যাম্পের সাবেক বন্দিরা অভিযোগ জানান, এগুলোতে বন্দিদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন, মেডিক্যাল নিরীক্ষা ও গণধর্ষণ চালানো হয়। 

গত সপ্তাহে জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যসহ ২৩টি দেশ উইগুরদের বিরুদ্ধে চীন সরকারের দমন-পীড়নের তীব্র নিন্দা জানায়। তারা মানুষের অধিকার ও নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সম্মান জানানোর আহবান জানায় দেশটির প্রতি।