• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

পিরোজপুর সংবাদ

যেভাবে তরুণী সংগ্রহ করে দুবাইয়ে পাচার করতো আজম সিন্ডিকেট

পিরোজপুর সংবাদ

প্রকাশিত: ১৪ জুলাই ২০২০  

বাংলাদেশ থেকে ১০ দালালের মাধ্যমে সুন্দরী তরুণীদের সংগ্রহ করার পর তাদের জোর করে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হতো। এসব তরুণীর মাধ্যমে বছরে ১৯২ কোটি টাকা উপার্জন হতো আজম খানের। চাকরির নামে এক হাজারের বেশি তরুণী-কিশোরীকে দুবাইয়ে পাচার করে তাদের অনৈতিক কাজে জড়াতে বাধ্য করেন আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের মূলহোতা আজম খান। এ বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন তিনি।

আদালতে আজম খান ও তার সহযোগী ডায়মন্ডের স্বীকারোক্তমূলক জবানবন্দি থেকে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ১০ দালালের মাধ্যমে সুন্দরী তরুণীদের সংগ্রহ করতো দালালরা মেয়েদের প্রলুব্ধ করে নির্ধারিত দু’টি বিদেশি এয়ারলাইন্স এজেন্সির মাধ্যমে দুবাই পাঠাতো। দুবাইতে তাদের নেওয়া হতো আর্টিস্ট ভিসায়। দুবাই যাওয়ার পরে তাদের প্রথমে ছোটখাটো কাজ দেওয়া হতো। এরপর জোরপূর্বক ড্যান্স ক্লাবে নাচতে বাধ্য করা হতো। আটকে রাখা হতো, খাবার দেওয়া হতো না, শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো। বৈদ্যুতিক শক পর্যন্ত দেওয়া হতো এবং দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হতো।

এসব তরুণীর মাধ্যমে দুবাইয়ের ৪টি হোটেল থেকে বছরে ১৯২ কোটি টাকা উপার্জন হতো আজম খানের। এসব হোটেলে খরিদ্দারের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের বড় মাপের ব্যবসায়ীরা। গতকাল সোমবার আদালতে আজম খান ও তার সহযোগী আল আমিন ওরফে ডায়মন্ডের ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে বলে মামলার তদন্ত তদারক সূত্রে জানা গেছে।

সিআইডি ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, রিমান্ডে থাকা আজম খান চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। গতকাল সে ও তার এক সহযোগীসহ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে দেশে ও বিদেশের কয়েকজন ব্যবসায়ীর নাম উঠে এসেছে। যারা নিয়মিত আজম খানের হোটেলে আসা-যাওয়া করত। এছাড়া দেশে তাদের অন্তত অর্ধশতাধিক দালাল রয়েছে। যাদের মাধ্যমে নারীদের সংগ্রহ করা হতো। তাদের নামও পাওয়া গেছে। এখন তাদের গ্রেপ্তার করতে পারলে এই চক্রের জাল ছিন্নভিন্ন করা সম্ভব হবে। তারা এসব নারীর আর্টিস্ট ভিসার মাধ্যমে পাচার করত বলেও তদন্তে উঠে এসেছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই তাদের নাম, ঠিকানা প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ড্যান্সবার, কফি শপ ও দেহব্যবসা চালিয়ে দুবাইয়ে ৪টি হোটেলের মালিক বনে গেছেন আজম খান। এসব হোটেলে নারীদের কাজ দেওয়ার নাম করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নারীদের সংগ্রহ করা হতো। প্রথমে তাদের ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেতনের চাকরির অফার করা হতো। এক পর্যায়ে তাদের আগাম এক মাসের বেতনও দেওয়া হতো। এসব কাজ করত আজম খানের বিশ্বস্ত সহযোগী আল আমিন ওরফে ডায়মন্ড। এই ডায়মন্ড এক এক নারী প্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পেত।

আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে ডায়মন্ড বলেছেন, নারীদের ফোন নম্বর ও ঠিকানা ম্যানেজ করার দায়িত্ব ছিল তার। এরপর তিনি এসব নারীর তথ্যগুলো উচ্চমাপের দালাল লুবনা মরিয়ম, সোহেল রহমান, ইভান শাহ্‌রিয়ার সোহাগ, অসিম, জসিম, সজিব, মাইনুদ্দিন অনিক সোহেল, ওয়াসেক মোন্তাকিনুর রহমান, আনিসুল ইসলাম হিরুকে দিত। এরাই এসব নারী ফুসলিয়ে আর্টিস্ট ভিসায় দুবাইয়ে আজম খানের কাছে পাঠিয়ে দিত। দুবাইয়ে নারী পৌঁছানোর পরপরই ডায়মন্ডের কাছে টাকার ভাগ চলে আসত। এরপর ওই নারীরা দুবাইতে পৌঁছানোর পর তাদের হোটেলে ডান্স করার কথা বললে অনেকে রাজি হতো না। এ কারণে তাদের ওপর নির্যাতনও চলত। খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় এক পর্যায়ে তারা বাধ্য হয়ে এসব কাজে জড়াত।

নারী পাচারকারী চক্রের এই সদস্যরা আগেও একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছে। জেল থেকে বের হয়ে তারা আবারও একই পেশায় জড়িয়ে পড়েছে বলেও জানা গেছে। তাদের দ্রুতই গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।

সিআইডির কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ূ, এসব নারীর তালিকায় রয়েছে ভবঘুরে, বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে কর্মরত সুন্দরী নারী, আবার ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে আসা যাওয়াকারী তরুণীরাই বেশি। অনেকে জেনেশুনেই দুবাইতে যেত। আবার অনেকে মোটা বেতনের লোভে পড়ে চলে যেত। তবে জেনেশুনে যাওয়ার সংখ্যাই বেশি।

সূত্র জানায়, আজম খানের নামে দুবাইতে চার তারকাযুক্ত তিনটি ও তিন তারকাবিশিষ্ট একটি হোটেল রয়েছে। হোটেলগুলো হচ্ছে ফরচুন পার্ল হোটেল অ্যান্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল রয়েল ফরচুন, হোটেল ফরচুন গ্র্যান্ড ও হোটেল সিটি টাওয়ার। এসব হোটেলে প্রতিরাতেই নির্দিষ্ট ১৫ জনের জন্য রুম বরাদ্দ থাকত। তারা ভারত ও বাংলাদেশের বড় মাপের ব্যবসায়ী। প্রতি

রাতে ১৫ জনের বেশি তিনি হোটেলে রাখতেন না। এজন্য তাদের কাছ থেকে ৪ হাজার দিরহাম নেওয়া হতো। এছাড়া কফি শপের আড়ালেও অসামাজিক কার্যক্রম চালানো হতো। সেখানে ঘণ্টায় ১শ দিরহাম নেওয়া হতো। ডান্সবারে যেতে হলেও আলাদা টাকা দেওয়া লাগত। এসব থেকে বছরে ১৯২ কোটি টাকা উপার্জন করত আজম খান। করোনাকালে এসব হোটেলে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এসব নারীর টাকার ঘাটতি দেখা দেয়। তখন তারা আজম খানকে বারবার কল করেও না পেয়ে দুবাই পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে আজম খানের নাড়িনক্ষত্র বেরিয়ে আসে। এরপরই দুবাই পুলিশ আজম খানের ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশ দূতাবাসে জানা?য় এবং তার পাসপোর্ট বাতিল করে দেয়। এরপর এক্সিট পাস নিয়ে আজম দেশে চলে আসেন। তারপর থেকে আত্মগোপনে যান। বিদেশ থেকে টাকার কোনো উৎস দেখাতে না পারায় দু-একদিনের মধ্যে আজম খানের নামে মানিলন্ডারিং মামলার প্রস্তুতি চলছে। পাশাপাশি দেশে তিনি কোথায়, কী সম্পত্তি করেছে তাও সন্ধান করে দেখা হচ্ছে।

সূত্র আরও জানায়, বিদেশে পাঠানো তরুণীদের মধ্যে সারা নামে এক তরুণীকে পছন্দ হয় আজম খানের। চাঁদপুরের মতলবের ওই তরুণী দেশে ফিরে এলে তার বাড়িতে যান আজম খান। এরপর ওই তরুণীকে একটি ডুপেস্নক্স বাড়ি করে দিয়ে মন জয় করেন। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্নস্থানে তার নামে বেনামে একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। ওইসব ফ্ল্যাটে হাই প্রোফাইলের নারীদের দিয়ে দেহব্যবসা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতেও তার সম্পত্তি রয়েছে। তিনি বিএনপির রাজনীতিও করতেন বলে জানা গেছে।

দুবাই থেকে গত রোববার রাতে ফিরে আসেন আরও ৫ তরুণী। তাদেরকে মঙ্গলবার সিআইডি কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছে। এই নারীদের কাছ থেকেও আরও একাধিক নারী পাচারকারীর তথ্য পাওয়া যাবে বলে ধারণা সিআইডির তদন্ত তদারক কর্মকর্তাদের।

ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, গত আট বছরে এভাবে চাকরির নামে দেশের হাজারেরও বেশি তরুণী-কিশোরীকে দুবাইয়ে পাচার এবং তাদের দেহব্যবসায় জড়াতে বাধ্য করেছে আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী এই চক্রের সদস্যরা। দুটি বিদেশি এয়ারলাইন্স এজেন্সির মাধ্যমে দুবাই পাঠানো হতো। দুবাই যাওয়ার পরে তাদের প্রথমে ছোটখাটো কাজ দেওয়া হতো। এরপর জোরপূর্বক ড্যান্স ক্লাবে নাচতে বাধ্য করা হতো। ওই এজেন্সিরও সন্ধান করা হচ্ছে।

ডিআইজি বলেন, দুবাইয়ে আজমের আরও দুই ভাই রয়েছে। তারাও একই ব্যবসা করেন। দেশে দালালদের তালিকায় রয়েছে- নিজাম, স্বপন, জিলস্নু, তানভীরসহ আরও অনেকে। তারাই মূলত দেশ থেকে তরুণীদের সংগ্রহ করার কাজে নিয়োজিত ছিল। এসব দালালের গ্রেপ্তারেও কাজ করে যাচ্ছে সিআইডি। এ ঘটনায় সিআইডি বাদী হয়ে গত ২ জুলাই রাজধানীর লালবাগ থানায় একটি মামলা করেছে। ওই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।